জাকির হোসেন লিটন-২০৪১ সাল পর্যন্ত নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও আওয়ামী লীগের টার্গেট অন্তত আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা। সে জন্য আগামী নির্বাচনেও মতায় আসা নিশ্চিত করতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যত ধরনের কৌশল নেয়া দরকার, তার সবাই নেয়া হবে। তাই সরকারবিরোধী বিএনপি জোটের নির্বাচনকালীন সহায়ক বা অন্য কোনো সরকারের দাবি মেনে নেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন সরকারি দলের নেতারা। এ ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে না এলেও কোনো উদ্যোগ নেবে না সরকার। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নানা উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কম করে হলেও আরো পাঁচ বছর সময় প্রয়োজন। আর এই উন্নয়নকার্যক্রম শেষ হলে তা আওয়ামী লীগের জন্য সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক সুফল বয়ে আনবে। অন্য দিকে বিএনপি জোট ক্ষমতায় গেলে বা কোনো কারণে আওয়ামী লীগ আগামী মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে না পারলে এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়তে পারে। সে জন্য আগামী মেয়াদেও ক্ষমতায় থাকতে চায় আওয়ামী লীগ।
এ ছাড়া পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। সরকারের মারমুখী অবস্থান এবং হামলা, মামলা ও দমন-পীড়নের মুখে গত কয়েক বছর রাজপথে দাঁড়াতে পারেননি নেতাকর্মীরা। এতে কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সরকার। সে জন্য আগামী মেয়াদেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে এবং বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকলে দলটি নামসর্বস্ব দলে পরিণত হবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। এতে বিএনপি নেতাকর্মীরাও চরমভাবে হাতাশায় পড়বেন; যা পরবর্তী মেয়াদগুলোতেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতাচ্যুত হলে দলটির নেতাকর্মীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা নেতাদের। বিএনপি জোট নেতাকর্মীদের ওপর যে দমন-পীড়ন চলেছে, তার চরম মূল্য দিতে হতে পারে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। সে জন্য আপাতত আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুইজন নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের গত দুই মেয়াদে বিএনপি নেতাকর্মীরা ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। অনেকেই এখনো নিখোঁজ বা গুম রয়েছেন। এবার তারা কোনোভাবেই ক্ষমতায় এলে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের আরো করুণ পরিণতি হতে পারে। সে জন্য আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।’
আওয়ামী লীগের আরো একাধিক নেতা জানান, আগামী ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তী জমকালোভাবে উদযাপন করা হবে অনেক আগে থেকেই এমন ঘোষণা দিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনসহ একাধিক অনুষ্ঠানে এমন ঘোষণা দেন। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই বলা হয়েছিল, বাংলাদেশকে মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা হবে। সরকারি দলের মতে, এরই মধ্যে নি¤œমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে পৌঁছার আশা করছে সরকার।
এ ছাড়া ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে চায় আওয়ামী লীগ। এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মিলনমেলার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে; যা ক্ষমতার বাইরে থাকলে সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই আগামী মেয়াদেও মতায় আসা নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে প্রথমটির কাজ ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয়টির নির্মাণকাজ ২০২৪ সালে শেষ করে তা চালু করার কথা রয়েছে।
রাজধানীর উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। এই মেট্রোরেলের পুরো কাজ শেষ হতে আগামী ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।
বহুল আলোচিত, প্রতীতি এবং দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের মর্যাদা ও ভাবমর্যাদার জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ ছিল। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পের অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নিলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় সরকার। সে অনুযায়ী সেতুর কাজ এগিয়ে চলছে। আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলা শুরু হবে বলে ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। তবে অনিবার্য কারণে নির্মাণকাজ শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছু সময় বেশি লেগে যেতে পারে।
এ ছাড়া এলএনজি টার্মিনাল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি বিদুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ১০টি মেগা প্রকল্পের কাজও চলছে। আওয়ামী লীগ মতায় থেকেই এই প্রকল্পগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করতে চায়। আর এটা করতে হলে আগামী মেয়াদেও আওয়ামী লীগকে মতায় আসতেই হবে। না হলে এসব প্রকল্পের কোনো কোনোটি স্থগিত আবার কোনো কোনোটি পরবর্তী সরকারের মেয়াদে শেষ হলে তার সুফল ওই সরকারই পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ দিকে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যে সহায়ক সরকারের কথা বলছে, সে ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। বিএনপির এই দাবি মেনে নেয়া বা কোনো ছাড় দেয়া হলে তার সুফল বিএনপির ঘরে যাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। কারণ, নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে বিরোধীদের দাবি মেনে নেয়া হলে তা হবে এক ধরনের পরাজয়; যা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে অন্য কোনো সরকার বা ফর্মুলাকে কোনোভাবেই নিরাপদ মনে করতে পারছে না। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন শেষ করতে চায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, সহায়ক সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা সংবিধানবহির্ভূত নির্বাচনকালীন কোনো সরকারের ফর্মুলাই মেনে নেয়া হবে না। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এ েেত্র কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
আওয়ামী লীগ সরকার আবারো ক্ষমতায় আসবে আশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে। দেশে উন্নয়নের এক মহাযজ্ঞ চলছে, যা সমাপ্ত করতে হলে আওয়ামী লীগকেই আবারো ক্ষমতায় যেতে হবে। এ ছাড়া দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেই ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে চায়। সে জন্য জনগণ আগামী নির্বাচনে আবারো আওয়ামী লীগকেই বিজয়ী করবে বলে আমরা আশাবাদী।
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এবার কোনো ধরনের ছাড় বা সমঝোতার পথে একদমই হাঁটবে না আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। সংবিধান অনুযায়ী এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। আর বর্তমান সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের আইনি সহায়তা দেবে।
এটাই হবে সহায়ক সরকার। এর বাইরে আর কোনো সরকারের ফর্মুলা মানা হবে না। সংবিধানের একচুল বাইরেও আমরা যাবো না। সে ক্ষেত্রে বিএনপি এবারো নির্বাচনে না এলে তাতে সরকারের কিছু করার নেই। তবে তারা এবার আর সেই ভুল করবে না। তারা স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা যাচাই করেছে। এ সরকারের অধীনে এসব নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অবাধ হবে এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি অবশ্যই আসবে।