একাত্তরের ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মনে করেন নবগঠিত ‘আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি)’ সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মনজু।
তিনি এও বলেন, আমার কেন যেন মনে হয় জামায়াত একাত্তরের জন্য কোনো না কোনো সময় ক্ষমা চাইবে। এটা শুধু সময় এবং পরিস্থিতির ব্যাপার মাত্র। রোববার যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে কেন দল গঠন, জামায়াতে ইসলামীর বি-টিম কিনা, ব্যারিস্টার রাজ্জাকের ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দলের অবস্থান, জোটে যাওয়া-না যাওয়া, দলের ভিশনসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন এবি পার্টির এই নেতা।
প্রসঙ্গত, শনিবার ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ (এবি পার্টি) নামে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারপন্থীরা।সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মনজুকে সদস্য সচিব করে ২২২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীতে সংস্কার ও মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার জন্য জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গে মুজিবুর রহমান মনজু বলেন, জামায়াত থেকে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগ ও আমার বহিষ্কারের পর জামায়াত ঘোষণা দিয়েছে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল করবে। তাদের এই সিদ্ধান্ত যদি তারা বাস্তবায়ন করে তাহলে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হবে যে, আমাদের সংস্কারের দাবি যৌক্তিক ছিল।
আর দেখুন, জামায়াত এক সময় বিএনপি-আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে স্বৈরশাসককে হটিয়েছে। বিএনপির বিরুদ্ধে কেয়ারটেকার ইস্যুতে আন্দোলন করেছে, বিএনপি’র হাতে জামায়াতের অনেক লোক মারা গেছে।
জামায়াতের হাতেও বিএনপি’র লোক মারা গেছে। সেই বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াত জোট করেছে, ক্ষমতায় গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জামায়াত এক সময় বলত ভারতের দালাল, ষড়যন্ত্রকারী। কিন্তু এখন জামায়াত অফিসিয়ালি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ‘স্থপতি বা স্বপ্নদ্রষ্টা’।
যে মুক্তিযোদ্ধারা ’৭১-এ জামায়াতের চোখে বিশ্বাসঘাতক-ষড়যন্ত্রকারী ছিল, জামায়াত এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’ বলে সম্মান দেয়। তাই আমার কেন যেন মনে হয়, জামায়াত ’৭১-এর জন্য কোনো না কোনো সময় ক্ষমা চাইবে। এটা শুধু সময় এবং পরিস্থিতির ব্যাপার মাত্র।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দলের অবস্থান পরিষ্কার করেন এবি পার্টির এই নেতা। তিনি বলেন, লাখো প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় আমাদের অবিস্মরণীয় জাতীয় অর্জন। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে এই অর্জনের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো ধরনের দ্বিধা, হীনম্মন্যতা, বিভক্তি ও বিদ্বেষ কোনো সুনাগরিকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল একটি শোষণমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
যারা এটা মানেন না বা বিশ্বাস করেন না এবং এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে রাষ্ট্রকে ভুল পথে নিয়ে এসেছেন তারা কেউ দেশের প্রকৃত বন্ধু নন। আমরা মনে করি, ’৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি এই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর।
করোনার এই সংকটের মধ্যে নতুন দল গঠনের প্রয়োজন মনে করলেন কেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে মনজু বলেন, দল গঠনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কাছাকাছি পর্যায়ে এসেও বন্যা ও ডেঙ্গু পরিস্থিতির কারণে ইতোমধ্যে দু’বার আমরা দল ঘোষণার তারিখ পিছিয়েছি।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আমরা দেখলাম করোনার মতো উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সবাই নিজেকে রক্ষা করার জন্য স্বেচ্ছাবন্দিত্ব গ্রহণ করছে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীর জন্য স্বেচ্ছাবন্দিত্বের কোনো সুযোগ কি আছে?
রাজনৈতিক কর্মীকে সতর্কতা অবলম্বন করে ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জাতির বিপদ মোচনে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দল তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেশ বাঁচাতে নীতি ও কর্মকৌশল প্রণয়ন করবে। তাহলেই সেই দল সত্যিকার দেশপ্রেমিক ও নাগরিকবান্ধব দল হিসেবে পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠা পাবে। তাই করোনাকালকে আমরা দল ঘোষণার উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করেছি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি পক্ষ বলছে আমরা কিংস পার্টি, সরকারের বা এজেন্সির দালাল, মুনাফেক, পথভ্রষ্ট, বেইমান আরও কত কী! আমি মনে করি, শুরু থেকেই আমাদের সব কার্যক্রম স্বচ্ছ ও স্পষ্ট।
আমরা এমন শক্তিশালী নই যে, এত বড় বড় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ফাঁকি দিয়ে কারও বি-টিম হওয়ার জন্য কাজ করার মতো বোকামি করব। আর এই দেশে দালাল, বেইমান ও কিংস পার্টির উদ্যোক্তাদের পরিণতি আমরা জানি। অতএব দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমরা যারা এ উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা অনেক পোড় খাওয়া লোক। বোকার মতো কোনো হটকারী কাজ আমরা করব না।
ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলাদেশ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চলছে। দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আপনার দল এ রকম কোনো চক্রান্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা- জনমনে সৃষ্টি হওয়া এমন অভিযোগ সম্পর্কে কী বলবেন।
জবাবে মনজু বলেন, দেখুন আমাদের অভিজ্ঞতা হল, কোনো চক্রান্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বা থেকে রাজনৈতিক দলকে বেশিদূর এগিয়ে নেয়া যায় না। তবে ইতিহাস থেকে আমরা দেখি রাজনৈতিক নেতারা সব সময় এ ধরনের সন্দেহ সংশয় ও ব্লেম গেইমের শিকার হয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র ৬ দফাকেও বলা হয়েছিল এগুলো একটা চক্রান্তের দফা।
আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি সেটা কোনো চক্রান্তের বিষয় নয়। এটা একটা মৌলিক ও স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ।
এবি পার্টি জামায়াতে ইসলামীর ‘বি-টিম’ বলে অনেকে মনে করছেন- এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কেউ বলছে জামায়াতের বি-টিম, আবার কেউ বলছে আমরা সরকারের বি-টিম।
সরকার এবং জামায়াত দু’পক্ষই আমাদের গালি দিচ্ছে ও চরিত্র হননের চেষ্টা করছে। উভয়পক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে একজোট। এটা খুবই মজার ব্যাপার। দেখুন, আমরা যদি কারও দালাল বা বি-টিম হই সেটা তো আমাদের কাজেই প্রকাশ হয়ে যাবে তাই না? আমার অনুরোধ থাকবে, সবাই আমাদের কাজ ও কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করুন। কোনো দোষ-ত্রুটি পেলে ধরিয়ে দিন। শুধু ধারণা আর কল্পনা দিয়ে আমাদের বিচার করা সঠিক হবে না।
দলে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের ভূমিকা কি হবে জানতে চাইলে মনজু বলেন, তিনি একজন খ্যাতিমান আইনজীবী এবং সজ্জন মানুষ। আমরা যখনই তার সাহায্য ও পরামর্শ চেয়েছি তিনি আমাদের যথার্থ পরামর্শ দিয়েছেন ও সহযোগিতা করছেন।
আবদুর রাজ্জাক ছাড়াও দেশের সিনিয়র সিটিজেন ও বুদ্ধিজীবীসহ অনেকেই পরামর্শক হিসেবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাদের কেউ কেউ হয়তো কোনো না কোনো সময়ে আমাদের সরাসরি নেতৃত্বেও আসতে পারেন। সময়ের ব্যবধানে সেটা দেখা যাবে।
কোনো জোটে যোগ দেবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে এবি পার্টির এই নেতা বলেন, না, এখন কোনো জোটে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আমরা ভাবছি না। সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।
ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া রাজনৈতিক দলের সে অর্থে জনগণের সেবা করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দল হিসেবে দক্ষতা দেখানোর সুযোগও কম। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো সুপ্রতিষ্ঠিত বড় দুটি দল থাকতে আপনারা কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে এবি পার্টির সদস্য সচিব মনজু বলেন, ‘আমরা তো অবশ্যই ক্ষমতায় যেতে চাই।
ক্ষমতায় যদি না যেতে পারি দেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলব কীভাবে। তাই দেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, প্রত্যেক স্তরে নেতাকর্মী তৈরি করে ক্ষমতায় যাব ইনশাআল্লাহ।’
এবি পার্টির ভিশন সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের মূল ভিশন ও লক্ষ্য হল বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। ’৭১ সালে যে প্রথম রিপাবলিক গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম তা বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি, কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক মুক্তি, গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এগুলো নিশ্চিত করা যায়নি।
তাই আমাদের উপলব্ধি হল এখন এ দেশের মৌলিক পুনর্গঠন দরকার, যাকে আমরা বলছি সেকেন্ড রিপাবলিক। আমরা বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করব। এজন্য ৭ দফা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।