মাসুদ মজুমদার-এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর থেকে সবসময় আলোচনায় ছিলেন, আছেন। এখন তিনি দু’ধারী তলোয়ার। যেন শাঁখের করাত, যেতেও কাটেন, আসতেও কাটবেন। তাকে প্রধান বিচারপতি বানানোর পর অনেকেই উসখুস করেছেন। কোথায় যেন একটা ব্যত্যয় ছিল। তিনি মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোক হওয়ার কারণে কারো আঁতে ঘা লেগেছে কি না, তাও স্পষ্ট নয়। মনিপুরীরা বাংলাদেশের আদিবাসী নয়, কিন্তু অধিবাসী। বিভিন্ন কারণে তারা এ দেশে এসে বসবাস শুরু করেছে। তারা সম্প্রদায় হিসেবে শান্তিকামী। একই সাথে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুসারী। এরা মূলত সাধারণ অর্থে হিন্দু নয়, চৈতন্যবাদী সনাতন ধারার ধর্মের অনুসারী। তবে তাদের অনেকেই মুসলিম। বাংলাদেশের ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মনিপুরীদের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এর মধ্যে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেটে বাস করে যথাক্রমে ১৩, ৪ ও ৭ হাজার। মনিপুরী হোন আর অন্য সম্প্রদায়ের হোন, নাগরিক হওয়ার শর্তে এস কে সিনহা অভিযোগমুক্ত হওয়ার কারণেই বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
এস কে সিনহা এখনো আলোচনার শীর্ষে। তার বিদেশ যাওয়া এবং এ বিষয়ে সরকারি বক্তব্যে দেশে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। সব দেখেশুনে মনে হয় ‘কতলে হোসেইন মরগে ইয়াজিদ’-এর মতো অবস্থা। মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহরের ভাষায়- হোসেইন খুন হলেও মরে যায় ইয়াজিদ। তেমনি সিনহা বাবুর বিদায় ও ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে সরকারই যেন জনগণের চোখে হয়ে গেছে ফতুর। সব কিছু লেজেগোবরে হয়ে গেছে।
একটু পেছনে তাকানো যাক। গত ২ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খোলার আগের দিন এক মাসের ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি সিনহা। আগের দিন রাতে তার বাসায় নাকি অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। কারা কিভাবে কী নাটক মঞ্চায়ন করেছেন- সেটা আমরা দেখিনি, জানিও না। তবে সোজা হিসাব, যেকোনো ধরনের নাটকীয় ঘটনা ঘটাতে হলে সরকারের হাত থাকতে হয়। বিশেষ করে সুরক্ষিত প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যে কেউ ঢুকতে পারে না। আইনজীবী নেতারা তার সাক্ষাৎ চেয়েও অনুমতি পাননি। এরপর অভিযোগ ওঠল, এভাবে ছুটিতে যাওয়া অস্বাভাবিক। কারণ ইতিহাস-ঐতিহ্যে এমন নজির নেই। কিন্তু সরকারি মুখপাত্ররা সত্য গোপন করলেন। শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হলো, আইনজীবী সমিতি, বার নেতৃবৃন্দ, প্রবীণ আইনজীবী এবং বিভিন্ন বিরোধী দল তাৎক্ষণিক যে অভিযোগ তুলেছিল সেটাই ছিল সত্য। এর আগে প্রধান বিচারপতি ১০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর দেশের বাইরে ছুটিতে ছিলেন। ছুটির ফাঁকে বৈঠকাদিতে তিনি অংশ নিয়েছেন। সাধারণত এ ধরনের দীর্ঘ ছুটি শেষে প্রধান বিচারপতি প্রথম কর্মদিবসে কতগুলো প্রথা অনুসরণ করেন। ছুটি শেষে সেসব প্রথা পালনের জন্য তিনি প্রস্তুতও ছিলেন। হঠাৎ করে প্রধান বিচারপতির ছুটি নেয়া শুধু নিয়মের ব্যত্যয় নয়, অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকারি মুখপাত্ররা কোনো জবাব দিলেন না, নানা ঢঙে কথা লুকালেন। সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি তাৎক্ষণিকভাবে বললেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে ছুটি নিতে ও বিদেশ যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।’ পুরো জাতি কান খাড়া করে থাকল, প্রকৃত সত্যটা কখন শুনবে। শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হলো- ষোড়শ সংশোধনীবিষয়ক রায় নিয়ে সংসদে, সংসদের বাইরে সরকারি দলের মুখপাত্ররা যে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির ছুটি ও বিদেশ যাওয়া সেই বাধ্যবাধকতার জের ছাড়া আর কিছু নয়।
বিদেশ যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি বার নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ দেননি; মিডিয়া এড়িয়ে গেছেন। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতর তিনি অস্ট্রেলিয়া দূতাবাস ও দুটো মন্দিরে গেছেন। এক ফাঁকে আইসিডিডিআরবিতেও গেছেন। কোথাও মুখ খোলেননি। বিমানবন্দরে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে মাত্র দুই মিনিট তিনি মিডিয়ার সাথে কথা বলে জানিয়েছেন, তিনি বিব্রত, সম্পূর্ণ সুস্থ এবং বিচার বিভাগ নিয়ে তার শঙ্কা রয়েছে। দুই মিনিট মিডিয়ার সামনে কথা বলে- এর মাধ্যমে এস কে সিনহা কতটা অনমনীয় অবস্থান ও দৃঢ়তার পরিচয় দিলেন- কিংবা দূরদর্শিতা বা বোকামির পরিচয় দিলেন, সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে জনগণ ধরে নিয়েছে, তিনি শির দিতে প্রস্তুত হলেও আমামা দিতে নারাজ থাকার কারণে এখন নানা অভিযোগের নাটকীয় ঘটনায় সরকারের ছুড়ে দেয়া বিষাক্ত শূলে বিদ্ধ।
এর মাধ্যমে এতদিন জনমনে যে জল্পনাকল্পনা চলছিল- ‘তাকে চাপ দিয়ে সরানোর প্রক্রিয়া হিসেবে এত সব করা হচ্ছে’, এটাই সত্যি প্রমাণিত হলো। এরই জের ধরে এক মাসের ছুটিতে বিদেশ যেতে বাধ্য করা হয়েছে তাকে। আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের সাথে কথা বলে প্রেসিডেন্ট হোমওয়ার্ক করেছেন এবং সুপ্রিম কোর্ট বিবৃতি দিয়েছে; ১১ জন কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন। জনগণ বিষয়টা এভাবেই দেখছে। এস কে সিনহা বলেছেন, রায়ের ব্যাপারে তাকে ভুল বোঝা হয়েছে কিংবা সরকারপ্রধানকে ভুল বোঝানো হয়েছে। সব ক’টি বিরোধী দল, দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এবং খ্যাতিমান সব আইনজীবীর ধারণা-অনুমান ও বক্তব্য শেষ পর্যন্ত জনগণকে এই ধারণাই দিচ্ছে, প্রধান বিচারপতি চাপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যেতে বাধ্য হয়েছেন এবং অসুস্থতা প্রসঙ্গে মন্ত্রীর দেয়া খবরটিও সত্য ছিল না। এখন যতসব অভিযোগের ডালি এবং তাকে তার পদ-পদবি থেকে ‘নাই’ করে দেয়ার মধ্যে সরকারি দলের ইচ্ছার প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নেই। মজার ব্যাপার হলো, তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, অন্য বিচারপতিদের সাথে বিরোধ কিংবা এক সাথে বিচারিক কাজে শরিক হতে আপত্তির খবর প্রচার করার জন্য সময় নেয়া হলো মাত্র কয়েক ঘণ্টা। সুরেন্দ্র বাবু যাওয়ার প্রাক্কালে মুখ না খুললে হয়তো সবই হতো, কিন্তু এত দ্রুততম হতো না।
এ ধরনের পরিস্থিতি যে একদিনে সৃষ্টি হয়নি, তা বোঝার জন্য অনেক বড় পণ্ডিত হতে হয় না। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ দীর্ঘ দিন ধরে নানাভাবে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিব্রত। শেষ পর্যন্ত ষোড়শ সংশোধনীর রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকারের অসহিষ্ণু আচরণের কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই ঘটল। নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সহ্য করতে পারছে না কিংবা বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকুক তা চায় না- এই তথ্য সুরেন্দ্র সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে একাধিকবার বিভিন্ন ভাষায় জানিয়েছেন। জানানোর পদ্ধতি সঠিক ছিল কি না, সেটা আলাদা বিষয়। এখন সরকার যত সাফাইয়ের ব্যবস্থা করুক, জনগণ যে বার্তাটি নিয়েছে- তার সারমর্ম হচ্ছে, এস কে সিনহা নন, স্বাধীন বিচার বিভাগই সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তাই নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণার পরও আসল সত্যটি আড়ালে থাকল না। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কিত। এই বক্তব্যই চারদিক থেকে আসা সব অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ। এখন প্রেসিডেন্টও আইনমন্ত্রীর মতো একটা পক্ষ হিসেবে অনভিপ্রেতভাবে ঘটনায় জড়িয়ে গেছেন। বিচার বিভাগের গায়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের কালিমা লেপনে হাত পড়েছে নির্বাহী বিভাগ ও আইন মন্ত্রণালয়ের।
সরকারই সিনহাকে পছন্দ করে প্রধান বিচারপতির আসনে বসিয়েছে। এখন যেসব অভিযোগ তা সত্যাসত্য প্রমাণসাপেক্ষ, তবে যুক্তির ধোপে টেকে না। এতভাবে স্খলিত(!) একজন মানুষকে প্রধান বিচারপতি বানানোর দায় খুব একটা ছোট ব্যাপার কি? সরকার এর মাধ্যমে জনগণকে শুধু ভুল বার্তাই দিলো না, দলীয় রাজনীতির ইমেজের তক্তপোষে শেষ পেরেকটিও ঠুকে দিলো। এ ক্ষেত্রে শেষ রক্ষার সুযোগ কম। তার পরও প্রধান বিচারপতি ছুটি শেষে স্বপদে বহাল হয়ে নিরাপদে আত্মপক্ষ সমর্থনের ও বিচার বিভাগের হাল ধরার সুযোগ পেলে অনেক বিতর্কের অবসান হবে। অন্যথায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কা কোনোভাবেই দূর হবে না। এ ফাঁকে সিনহার বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগ, রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে বিভক্তির রেখা টানার অনুযোগ, সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে ব্যাপক রদবদলের প্রজ্ঞাপন ইস্যু করে সরকার বিচার বিভাগের ভেতরে বাইরে ঝড় বইয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত কোন কোন বটবৃক্ষ উপড়ে পড়বে- তা বলা মুশকিল। তবে এটা নিশ্চিত, এস কে সিনহা বস্তুগতভাবে কিছুই হারাননি, যা কিছু হারিয়েছে তার সবটুকুই গেছে আওয়ামী লীগের ইমেজের বাক্স থেকে। মানুষ ইতিহাস হয় দু-একটি কারণে। একজন বিচারপতি সামরিক শাসক কর্তৃক আদিষ্ট হয়েও শপথ না পড়িয়ে অমর। অমরত্ব পেয়েছেন আরো ক’জন শুধু সত্যটা যথাসময়ে উচ্চারণ করেছেন বলেই। সিনহা বাবু ধোয়া তুলসী হয়তো নন, কিন্তু এখন তিনি খলের বিপরীতেই রয়েছেন। খলের ছলের অভাব হয় না, কিন্তু এর বিপরীতে যিনি থাকেন- তার সব দোষই মুছে যায়; জনগণের ধারণার কারণে সিমপ্যাথিটাও যায় তার পক্ষে। এ জায়গাটায় সরকার একেবারে রিক্ত।