প্রায় চার মাস হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের যাত্রা। বিশ্বজুড়েই মানুষ বিপর্যস্ত। বিপর্যয়কালেই মানুষের আসল চরিত্র উদ্ভাসিত হয়। মানুষের মানবিক দিকগুলো ফুটে ওঠে।আর যারা এখনও মানুষ হয়ে ওঠতে পারেনি তাদের পাষণ্ডতাও সবার সামনে প্রকাশ পেয়ে যায়। অন্যরা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে কিন্তু একজন মুসলিম তো ইসলামী আখলাক ও মানবিক মূল্যবোধ শূন্য হতে পারে না কখনওই।
একজন মুসলিমকে পরিপূর্ণ মানবিক হতে হয়। উন্নত আখলাকের অধিকারী হতে হয়। কথা-বার্তা যেমন আচার-ব্যবহারেও তার থাকতে হয় শুদ্ধতা। দিনে দিনে স্পর্শ করতে হয় উৎকর্ষতা।
এভাবেই একজন ইমানদার হয়ে ওঠে উন্নত মানবিক বোধের আধার। অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন চরিত্র মাধুরি, কোমল স্বভাব, হৃদয়বান, সেবাপরায়ন এবং আলোকিত মননের অধিকারী এক সত্তা।
মহামারীর আকার নেয়া মরণঘাতূ করোনাভাইরাস স্থবির করে দিয়েছে বিশ্ব সংসার। অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়ে নিঃস্ব নিরন্ন অবস্থায় রয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই এমন অভাব ও দুরাবস্থার ভেতর মানুষের ধর্মবোধ জেগে ওঠে। মৃত্যুর শংকার কারণে পাপের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। অনর্থক কাজ কারবার থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে সবাই।
এ কারণেই তো আল্লাহর রাসূল সা. মুমিনের জন্য মহামারীকে রহমত বলেছেন। মহামারী মুমিনের জন্য রহমত হওয়ার অর্থ হচ্ছে এ সময়ের নির্দেশনাগুলো মেনে চললে এমন কঠিন গজবকেও মুসলিমরা রহমত বানিয়ে নিতে পারে।
কঠিন বিপর্যয়কে রহমত হিসেবে গ্রহণ করা দারুণ ইতিবাচক মানসিকতার পরিচায়ক। ইসলাম আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে শিক্ষা দেয়। সব সময় আশাবাদী হতে বলে পবিত্র কুরআন।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না, নিঃসন্দেহে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে কাফের সম্প্রদায় ছাড়া কেউ নিরাশ হয় না। [সুরা ইউসুফ]
এ আয়াতে হতাশাকে ইমানের পরিপন্থী বলা হয়েছে। অন্য আয়াতে হতাশাকে বিভ্রান্তি ও দালালাত হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। [সুরা হিজর]
হজরত ইবন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে হতাশাকে কবিরা গুনাহ আখ্যা দেয়া হয়েছে। [তাবারানি] হয়ত হতাশার বিভিন্ন প্রকারের জন্য বিভিন্ন বিধান। হতাশা চরমে পৌঁছলে তা কুফুরির পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
সাধারণ নৈরাশ্য কবিরা গুনাহের কম নয় যেটিকে সুরা হিজরে পথভ্রষ্টতা বলা হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় কত বেশি আশাবাদিতার শিক্ষা দেয় ইসলাম আমাদের।
দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন থেকে কোনো ফায়দা তো নেই। সামনে কী হবে তা ভেবে ভেবে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করা কোনো বুদ্ধির কাজ নয়।
ইবাদত-বন্দেগি, যিকির-আযকার, তেলাওয়াত নামাজ-রোজা, দান-সদকা, তালিম ও দুয়া মুনাজাত ইত্যাদি ভালো কাজে সময় কাটাতে পারলে মনে অশান্তি থাকে না।
বিশ্বজুড়ে যত মানুষ আত্মহত্যা করছে তাদের অধিকাংশই কিন্তু দারিদ্রের কারণে নয়; চরম প্রাচুর্যে থেকেও ডিপ্রেশনের শিকার। তাদের এমন অবস্থার কারণ কী?
মূলত তাদের জীবনে আধ্যাত্মিকতার কোনো ছোঁয়া নেই। একজন মুসলিম যদি ইসলামের পথে দৃঢ় থাকে তাহলে তার এ ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ ইসলামে আধ্যাত্মিকতার একটি সুন্দর ধারা রয়েছে। অন্তরের গভীরে নিমগ্নতার পদ্ধতি রয়েছে।
ধ্যান-জ্ঞানে মহান সত্তাকে অনুভব করার শিক্ষা দেয় ইসলাম। সঙ্গে সঙ্গে আত্ম অনুসন্ধানের নির্দেশও আছে। নিজেকে খুঁজে দেখার উদ্দেশে যে নিজের আত্মা ও অন্তরের গভীরে ডুব দেয় তার সামনে উদ্ভাসিত বিরাট এক আনন্দের জগৎ তাকে বিমোহিত করে রাখে।
এমন মানুষ কখনও আত্মহত্যার কথা ভাবতেও পারে না। মনমরা হয়ে থাকতে পারে না সে কখনও। চির উদ্দোম ভরা উৎফুল্ল-প্রফুল্ল ও প্রশান্ত তার মন। আলোকিত ভালো লাগায় পূর্ণ সুন্দর এক জীবনের হাতছানি তার সামনে।
হাজার অভাবে থেকেও সে অনুভব করে পরম সুখ। যে কোনো অবস্থায় কৃতজ্ঞতা ও তৃপ্তির অনুভূতি তার মুখ দেখেই বোঝা যায়।
খিটখিটে মেজাজ না করে এ সময় সদাচারী-সদালাপি হওয়াই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। অর্থ সংকটে থাকলে মন মেজাজ ভালো থাকে না। কারো সঙ্গে হেসে কথা বলার মতো অবস্থা থাকে না।
এমন সংকট মুহূর্তেও যারা সদালাপ-সদাচার ধরে রাখতে পারে তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল আল্লাহর দরবারে।
করোনার ভেতর একজন মানবিক বোধসম্পন্ন ইমামের গল্প শোনাব।
মাগরিবের নামাজের সময় বাইরে থেকে এক তরুণ মুসল্লি আসল। এক কাতার ফাঁকা রেখে দাঁড়ানোর নিয়ম সে মসজিদে। নবাগত তরুণ মুসল্লির সে কথা জানা নেই। সে সামনের কাতারে মুআজ্জিনের পাশে ফাঁকা দেখে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
পাশের মুসল্লি সঙ্গে সঙ্গে জোরে জোরে বলল, ‘যাও, পিছনের কাতারে যাও।’ খুবই দুর্ব্যবহার করা হল তার সঙ্গে। পিছনের কাতারেও দাঁড়িয়ে গেছে মুসুল্লিরা। সেখান থেকেও চিৎকার করে তাকে পিছনে যেতে বলা হল। পিছনে যেতে যেতে একেবারে মসজিদের বারান্দায় স্থান হল তার।
নামাজ শেষে ইমাম সাহেব বললেন, ‘ভাই, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে সতর্কতার নামে যেন আমরা রুক্ষ আচরণ না করি। এই মুসল্লি তো জানে না আমাদের মসজিদের এ নিয়ম। তাকে যে আমরা এভাবে অপমান করলাম তা কি ঠিক হল?
ইসলাম আমাদের উন্নত আখলাকের শিক্ষা দেয়। ইসলামী ভাবনা থাকলে আমরা আরেকটু সুন্দর আচরণ করতে পারতাম। কাতারে আমার পাশে যখন দাঁড়িয়েছে, তাকে আমি বলতে পারতাম ভাই, তুমি দাঁড়াও এখানে, আমি পেছনে গিয়ে দাঁড়াই, কারণ করোনাকালীন একসঙ্গে মিশে দাঁড়ানো সাবধানতা পরিপন্থী।
সে তখন হয়ত আপনাকেই জোর করে আপনার জায়গায় রেখে পেছনে গিয়ে দাঁড়াত। এটা কি একটু সুন্দর হতো না?’
এই আলোকিত ইমামের নাম মাওলানা নুরুদ্দিন। টাঙ্গাইলের একটি মসজিদের ইমাম খতিব তিনি। সুন্দর সুন্দর চিন্তা বের করার সৃজনী ক্ষমতা তার ভেতর আছে।
আল্লাহ তার ভেতরে মানবিক বোধ আরও বাড়িয়ে দিন। আমরা সবাই যেন এমন সৃষ্টিশীল এবং ইতিবাচক ভাবনাসম্পন্ন হতে চেষ্টা করি সে উদ্দেশ্যেই এই ইমামের ঘটনাটি উল্লেখ করলাম।
আমরা সবাই একটু বুদ্ধি করলেই মানবিক আচরণ বের করে নিতে পারি যে কোনো পরিস্থিতিতে। সে জন্য প্রয়োজন শান্ত স্থির মন। পাপাচারে নষ্ট করে ফেলেছি আমাদের অভ্যন্তর। এখানে সুবোধের স্থান হয় না।
সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি সত্যি মানুষের জীবন বদলে দেয়। দৃষ্টিভঙ্গির অনন্যতা একজন মুসলিমের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের প্রকৃত মুসলিম হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।