ইসলামের চার স্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে জাকাত। শাহাদাতের পর নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত এই চারটি হচ্ছে ইসলামের রোকন।নামাজ রোজা লিখলাম। কারণ এটাই আমাদের অভ্যাস। তা না হলে পবিত্র কোরআনে সবসময় নামাজের সঙ্গে জাকাতের কথা আলোচনা করা হয়ে থাকে। নামাজ পড় জাকাত দাও। এভাবে পবিত্র কোরআনে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে।জাকাতকে এত বেশি গুরুত্ব কেন দেয়া হয়েছে? এ বিষয়টি বুঝতে হবে। নামাজ রোজা হজ তিনটিই হচ্ছে শারীরিক ইবাদত। অর্থাৎ যে ইবাদত করতে কোনো অর্থ ব্যয় হয় না। কেবল শারীরিক কসরত করতে হয়।
হজ করতে দূরের মানুষের যাতায়াত খরচ বাবদ কিছু ব্যয় হয়, কিন্তু বাইতুল্লাহর কাছের আরবের মানুষের সে খরচেরও প্রয়োজন পড়ে না। দেখা যাচ্ছে একমাত্র জাকাত হচ্ছে অর্থ সম্পদ ও মালের ইবাদত।জান মাল উভয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ইবাদত আদায় করলেই সত্যিকার মুসলিম হওয়া যায়। জাকাত দেওয়ার মাধ্যমে এ পূর্ণতা লাভ সম্ভব হয়।
মানুষের স্বভাবের মধ্যে বখিলি ও কার্পণ্য আছে। এই কার্পণ্য হচ্ছে একটি চারিত্রিক দুর্বলতা। কার্পণ্যের বদ স্বভাব বাড়তে বাড়তে এমন হয় যে, পার্থিব বিষয়ের প্রতি চরম পর্যায়ের মোহ তাকে পেয়ে বসে।মৃত্যুর সময় যখন সব সম্পদ ছেড়ে যেতে হবে তখন তার ভীষণ কষ্ট হওয়া স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারা যায়। দুনিয়ায় বখিলির মন্দত্ব তাকে যেমন বিপদে ফেলে তার চেয়ে বেশি বিপদে পড়ে পরকালের জীবনে।
জাকাত এ আপদ থেকে রক্ষায় সহায়কের ভূমিকা পালন করে। ধীরে ধীরে মানুষের স্বভাবের সংশোধন সম্ভব হয় জাকাত ও সদকার মাধ্যমে। নিয়মিত দানের মাধ্যমে দানশীলতা ও বদান্যতার গুণ স্বভাবে স্থিতি লাভ করে।জাকাত অনেকেই আদায় করেন আবার অনেক মানুষের ওপর হয়ত সারা জীবনে জাকাত ফরজই হয় না। কিন্তু আমাদের সবারই এর ফিলোসফিটা ভালো করে বুঝে নিতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে ইসলামি শরিয়াতের বিধানসমূহের তাত্ত্বিক দিক।
এখানে একটি বিষয় শুরুতেই বলে রাখি, আমাদের প্রিয় নবীর (সা.) ওপর সারা জীবনে কখনওই জাকাত ফরজ হয়নি। জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে তা রাসুলের (সা.) ক্ষেত্রে কখনও পাওয়া যায়নি।
কারণ রাসুল (সা.) নিজের কাছে কিছুই জমিয়ে রাখতেন না। যা কিছু তার প্রয়োজনাতিরিক্ত থাকত গরিব দুঃখির মাঝে বিলি বণ্টন করে দিতেন। সাড়ে ৫২ ভরি রৌপ্য বা তার সমমূল্য একবছর নবীজীর ঘরে পড়ে থাকা ছিল অসম্ভব। অনেক সময় আর কিছু না থাকায় নিজের গায়ের চাদরও দান করে দিয়েছেন এমন নজীরও আছে।
জাকাত বলতে আমরা কী বুঝি? এক বছর নেসাব পরিমাণ সম্পদ কারো কাছে জমা থাকলে চল্লিশ ভাগের একভাগ সম্পদ আল্লাহর জন্য গরিব দুঃখিদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশি ও মাদরাসা বা ইয়াতিমখানায় চল্লিশ ভাগের একভাগ সম্পদ দিয়ে দেয়া। এটা পারিভাষিক অর্থ।
শাব্দিক অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা। দান করার মাধ্যমে নিজের আত্মাকে কলুষমুক্ত করা হচ্ছে জাকাতের প্রধান লক্ষ্য। আত্মাকে পরিশোধনের ক্ষেত্রে জাকাতের বড় ভূমিকা রয়েছে।
বর্তমানে জাকাত এ অর্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে। চল্লিশ ভাগের এক ভাগ দান করাকেই জাকাত বলা হয় পরিভাষায়। কিন্তু ইসলামের শুরুর সময়ে যে কোনো দানকেই জাকাত বলা হতো।মূলত এখনও যে কোনো দানের ভেতর জাকাতের শাব্দিক অর্থ বহাল রয়েছে। পবিত্রতা। আত্মাকে পবিত্র করে দান সদকা। আত্মার পরিশোধনের ক্ষেত্রে যে কোনো দানেরই গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
মানুষ কোনো পশু নয়। একাকী বেঁচে থাকতে পারে না মানুষ। সামাজিক জীব হিসেবে তাকে অন্য সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে। ধনী যেমন বাঁচবে, গরিবকেও বাঁচাতে হবে। আল্লাহ যাদের অর্থ সম্পদ দিয়েছেন তাদের অবশ্যই আশপাশের মানুষের খোঁজ খবর নিতে হবে।রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ওই ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে না যে নিজের উদর পূর্তি করে অথচ তার প্রতিবেশী থাকে অভুক্ত। (তাবারানি)
কেবল জাকাত আদায় করলেই কি দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে? আমাদের অনেকেরই ধারণা এমন। জাকাত দেয়া হয়ে গেল তো আর কোনো দায়িত্ব থাকল না। এমন ধারণা মোটেও শুদ্ধ নয়।
মূলত এরা জাকাতের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেনি। ইসলামের বিধানাবলির গভীরে প্রবেশ করতে হবে আমাদের। জাকাতের বিধান শরিয়তে আবশ্যকীয় করে দেয়া হয়েছে। চল্লিশভাগের একভাগ আদায় না করলে পূর্ণ সম্পত্তি অপবিত্র থাকবে। কিন্তু এরপর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। জাকাত আবশ্যকীয় করা হয়েছে অভ্যাস করানোর জন্য।
একবার অভ্যাস হয়ে গেলে সমাজের ও জাতীয় প্রয়োজনে যেন অভাবী দুস্থ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারে। রাসুল (সা.) স্পষ্ট করে বলেছেন, জেনে রেখ, সম্পদে জাকাত ছাড়াও আরও হক রয়েছে। (তিরমিযি)
এখন করোনাভাইরাসের কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ চরম অবস্থার ভেতর রয়েছে। এসময় যারা বিত্তশালী আছেন জাকাত আদায় করলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যতদিন দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে না আসে ততদিন সাধ্যমত সবাইকেই চেষ্টা করতে হবে দুর্যোগ মোকাবেলা করার।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, লোকেরা আপনার নিকট জিজ্ঞেস করে তারা কী খরচ করবে? আপনি বলুন, প্রয়োজন অতিরিক্ত সব কিছুই ব্যয় করো। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৯)
এটাই ইসলামের শিক্ষা। কেবল জাকাত নয়। নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সদকার মর্মার্থ কেবল চল্লিশভাগের একভাগ নয়। চল্লিশ ভাগের একভাগ দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।মূল কথা হচ্ছে হামদর্দি ও সহানুভূতি। মানবিক বোধ ও সহমর্মিতার গুণ। সমাজের অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট থেকে উত্তরণে আন্তরিক প্রয়াস প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। যাদের ওপর জাকাত ফরজ নয় তাদেরও একথা বুঝে নিতে হবে। হাত গুটিয়ে না থেকে আমাদের ভেতর তৈরি করতে হবে বদান্যতা ও দানশীলতার গুণ।দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, মানুষের নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী, জাহান্নাম থেকে দূরে। বখিল আল্লাহ থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে, জাহান্নামের নিকটবর্তী। (তিরমিযি)
আসুন, এ পবিত্র মাহে রমজানে বেশি বেশি দান সদকা করি। ছিন্নমূল দুস্থ নিরন্ন ও সব অসহায়ের কষ্টগুলো উপলব্ধির চেষ্টা করি।
অভাবী অনাহারী মানুষের পাশে দাঁড়াই। এবং দানের হাতকে প্রসারিত করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।