‘আরিফ চৌধুরীর প্রতারণার শিকার আমি। সে আমাকে ব্যবহার করেছে, ফাঁসিয়েছে। যখনই তা বুঝতে পারি, তখনই তার কাছ থেকে দূরে চলে এসেছি। বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের দাম্পত্য কলহ চলছিল। তাকে তালাকের নোটিশও পাঠিয়েছি।’ করোনা টেস্টের নামে জেকেজির প্রতারণার ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন। ডা. সাবরিনাকে গতকাল মঙ্গলবার ৭ ঘণ্টা ধরে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জেকেজির কার্যক্রমে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। তবে পুলিশ তার ব্যাপারে অনেক তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে। যা থেকে স্পষ্ট, জেকেজি চলত সাবরিনার প্রভাবেই। এদিকে সাবরিনা ও আরিফ চৌধুরীকে শিগগিরই মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করবে মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জেল হাজতে থাকা আরিফ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আদালতে গতকাল পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। কাল রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ডা. সাবরিনা জানান, আরিফ চৌধুরীর কারণে আজ তাকে এই বিপদে পড়তে হয়েছে। ২০১৫ সালে আরিফকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর গুলশানে একটি বাসায় থাকতেন তারা। ওই বাসার এক পাশে চেম্বার ছিল তার। দুটি ফ্লোরে ছিল জেকেজির কার্যালয়।
পুলিশ জানিয়েছে, গুলশানের জেকেজির একটি ফ্ল্যাট থেকে এরই মধ্যে ল্যাপটপ জব্দ করা হয়েছে। ওই ল্যাপটপেই করোনা পরীক্ষার নকল রিপোর্ট তৈরি করা হতো। একই ফ্ল্যাট থেকে অনেক যৌন উত্তেজক জিনিসপত্রও পাওয়া যায়।
পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বা জেকেজি প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় আরিফ চৌধুরীর নানির নামে। একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০৬ সালে এটি জয়েন্ট স্টেক থেকে অনুমোদন নেয়। আরিফ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের পর ডা. সাবরিনাকে জেকেজির চেয়ারম্যান করা হয়। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ছিলেন আটজন। ধীরে ধীরে সবাইকে চলে যেতে বাধ্য করেন আরিফ চৌধুরী। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলেই এটি চালাতেন।
সাবরিনা দাবি করে আসছেন, তিনি জেকেজির চেয়ারম্যান নন। তবে পুলিশের তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন জায়গায় তিনি নিজেকে চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পরিচয়ে তুলে ধরেছেন। তিতুমীর কলেজের মাঠে জেকেজির করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্য বুথে গিয়ে গণমাধ্যমের সামনে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র হিসেবে উপস্থাপন করেন। সম্প্রতি গুলশান থানায় একটি জিডি করেন সাবরিনা। সেখানে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির অনারারি উপদেষ্টা হিসেবে। সোহেল নামে জেকেজির একজন বিশ্বস্ত কর্মীকে সাবরিনা তার মোবাইল ফোন থেকে মেসেজ পাঠান। সেখানে নিজের পদবি লেখা ছিল, ‘চেয়ারম্যান জেকেজি।’
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, আরিফকে ডিভোর্স নোটিশ পাঠানোর কথা জানালেও এ সংক্রান্ত কাগজপত্র সাবরিনা দেখাতে পারেননি। তাছাড়া সাবরিনা যখন একাধিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন আরিফের বোন তাকে মেসেজ পাঠিয়ে এসব ভুল তথ্য না দিয়ে মিডিয়ার কাছ থেকে দূূরে থাকার পরামর্শ দেন।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, করোনা নিয়ে জেকেজি প্রতারণা করে যে অর্থ হাতিয়েছে মূলত তার ভাগবাটোয়ারাই স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বের কারণ। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মীও অবৈধ অর্থের ভাগ চাচ্ছিল। যদিও আরিফ বেতনের বাইরে কোনো ভাগ দিতে নারাজ ছিলেন। এ কারণে জেকেজি থেকে প্রথমে বেরিয়ে যান হুমায়ুন কবীর হিমু ও তার স্ত্রী। তারা দু’জনে গিয়ে আলাদাভাবে করোনা টেস্টের নামে বাণিজ্য শুরু করেন। এক মাসের মধ্যেই হিমু এত টাকা হাতিয়ে নেন যে, প্রাইভেটকার কেনার কথা ভাবতে থাকেন।
সম্প্রতি আরিফ পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক সাবরিনাকে দিয়েছিলেন। চেকটি ডিজ-অনার হওয়ায় আরিফের ওপর ক্ষিপ্ত হন তিনি। করোনা পরীক্ষার নামে জেকেজি দিনে গড়ে সাত লাখ টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে। মোট আট কোটি টাকার মতো বাণিজ্য করে তারা।
পুলিশ জানায়, সাবরিনা স্বীকার করেছেন জেকেজি করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজটি পাওয়ার পেছনে সাবরিনাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তার পক্ষে প্রভাবশালী লবিস্ট গ্রুপ ছিল। তারাই সাবরিনার পক্ষ থেকে জেকেজিকে কাজটি পাইয়ে দিতে মূল ভূমিকা রাখেন। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, সাবরিনার সঙ্গে বিএমএর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক কামরুল হাসান মিলনের ‘সুসম্পর্ক’ আছে। জেকেজি ইস্যুতে বিপদ আঁচ করতে পেরে মিলনের সহযোগিতা চান সাবরিনা। কিন্তু পুলিশ ও গণমাধ্যকর্মীদের ‘ম্যানেজ’ করতে ব্যর্থ হয় এ সিন্ডিকেট। পুলিশ বলছে, প্রয়োজন হলে সাবরিনা ইস্যুতে আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সাবরিনার বাবা একজন সাবেক আমলা। তাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। তার স্বামী আরিফ চৌধুরীর বাড়ি বরিশালে। গুলশান-বনানীকেন্দ্রিক নানা পার্টিতে যাতায়াত ছিল এ দম্পতির।
জেকেজি ইস্যু গণমাধ্যমে আসার পর ডা. সাবরিনা প্রথমে খানিকটা বিচলিত হন। পরে তার বিশ্বাস জন্মে, অভিযান চালিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করবে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়ে পুলিশ প্রশাসন বড়জোর তাকে ডেকে নিতে পারে। গ্রেপ্তার এড়াতে হাসপাতালে, এমনকি বাইরেও অ্যাপ্রোন পরে থাকতেন তিনি। তার ধারণা ছিল, অ্যাপ্রোন পরা থাকলে পুলিশ হয়তো তাকে গ্রেপ্তার করার সাহস দেখাবে না।
এদিকে জেকেজির ইস্যুতে রোমিও এবং মাসুম বিল্লাহ নামে আরও দু’জনকে খুঁজছে পুলিশ। কার কার প্রভাব ও ইন্ধনে লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানকে করোনার নমুনা সংগ্রহ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তা বের করারও চেষ্টা চলছে।
পুলিশ জানায়, ওভাল গ্রুপ লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জেকেজি। এটি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান আরিফুল হলেও চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিতেন সাবরিনা। সাবরিনার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দিবসের কাজ পেয়ে আসছিল ওভাল গ্রুপ। গত বছরের অক্টোবরে ঢাকা এক্সপোর আয়োজন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনেও ওভালের চেয়ারম্যান হিসেবে বক্তব্য দিয়েছিলেন সাবরিনা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশিদ জানান, ডা. সাবরিনাই জেকেজির চেয়ারম্যান ছিলেন এমন অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানটির আরও কয়েকটি পরিচয়ে চলতেন তিনি। জেকেজি কেলেঙ্কারির সবই জানতেন তিনি। জেকেজির গ্রেপ্তার সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ডা. সাবরিনাই এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। গ্রেপ্তারের পর আরিফুল হক চৌধুরীও জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তার স্ত্রী সাবরিনার প্রভাবেই করোনা টেস্টের কাজ পেয়েছেন তারা। যদিও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা দায় স্বামীর ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন।