গোলাম সারওয়ার-মৃত্যু অমোঘ, অনিবার্য। ‘আকাশের লক্ষ তারা’ জীবনকে প্রতিনিয়ত ডাকছে। এই ডাক অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারও নেই। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যেই সুখ-দুঃখের ভেলায় জীবননৌকা কখনও শান্ত, কখনও বা ঊর্মিমুখর সাগরে এগিয়ে চলে। নৌকাটি কখন হঠাৎ থেমে যাবে, তা শুধু একজনই জানেন- যিনি অলক্ষ্যে বসে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই নিষ্ঠুর বিধাতা বেশ কয়েক মাস আমাদের আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলিয়ে প্রিয় আনিসুল হককে কেড়ে নিলেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সদা হাস্যমুখ মেয়র আনিসুল হক। ‘ডিএনসিসির মেয়র’, এ পরিচয় মোটেই মুখ্য নয়- তার বড় পরিচয় তিনি আমাদের লোক। আমাদের অতি প্রিয়জন।বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটি সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি যখন জানাল, তখন আমি সস্ত্রীক রায়েরবাজারে আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সদ্যপ্রয়াত সাংবাদিক-লেখক মাসুদুল হকের পরিবারকে সান্ত্বনা জানিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। মেয়র আনিসুল হককে যে আমরা বেশি দিন মায়ার বাঁধনে আর বেঁধে রাখতে পারব না, তা তার চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়ে দিলেও ‘হোপ অ্যাগেইনস্ট হোপ’- বাক্যটির ওপর ঈষৎ ভরসা করতে চাচ্ছিলাম আমরা। নিয়তি আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করল না। ‘স্বপ্ন সারথি’ এ শব্দ দুটির প্রতি আমার সবিশেষ দুর্বলতা রয়েছে।
গতকাল সহযোগী একটি পত্রিকা প্রথম পাতার শিরোনামে আনিসুল হককে ‘স্বপ্ন সারথি’ বলেছে। আসলেই আনিসুল হকের দু’চোখ ভরা ছিল স্বপ্ন। শত প্রতিকূলতা লঙ্ঘন করে স্বপ্নপূরণে আপন মেধা ও সাহসের সদ্ব্যবহার করতেন। যারা কাছ থেকে আনিসুল হকের দুটো চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছেন, তারা সম্ভবত লক্ষ্য করেছেন, তার চোখ দুটিতে আলোর রেখা। সে রেখা ঈষৎ, কিন্তু দ্যুতিময়। সে আলো তার স্বপ্নের কণিকা। চমৎকার করে কথা বলতেন আনিসুল হক। একদা টিভির লাখো দর্শক-শ্রোতার প্রিয় উপস্থাপক ছিলেন। রমণীর হৃদয় হরণ করার মতো তার চমৎকার বাক্যবিলাস আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ত টেলিভিশনের পর্দায়। আমরা মুগ্ধ হতাম। অনেকেরই শঙ্কা ছিল, রূপালি পর্দায় জনপ্রিয় তারকা সমস্যাসংকুল রাজধানীর মেয়র হিসেবে সফল নাও হতে পারেন। একটি সাধারণ ধারণা ছিল, আনিসুল হকের স্বপ্নের ভুবন আর বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান যোজন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সেই শঙ্কাকে অসার প্রতিপন্ন করার উদ্যোগ নিলেন তিনি। মেয়র অফিসের সবকিছু বদলে গেল। কাজ, কাজ আর কাজ। আমি নিজেই দেখেছি, রাত ২টায় গুলশানে নগর সংস্কারের কাজ মেয়র স্বয়ং তদারক করছেন। এই এক অবিশ্বাস্য দৃশ্যপট।
এ ব্যাপারে একাধিকবার তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। উত্তরার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়ার অনুরোধ জানালে তিনি কৌতুকভরে বলেছিলেন, এ কিন্তু স্বজনপ্রীতি হয়ে গেল সারওয়ার ভাই। তারপর বললেন, উত্তরার প্রতি আমার কিঞ্চিৎ পক্ষপাতিত্ব থাকবে। একদিন উত্তরার উন্নয়ন সকলের নজর কাড়বে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আনিসুল হক কোনো রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথানত করেননি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সবুজসংকেত পেয়েছিলেন তিনি। নিজে শতভাগ সৎ থাকার কারণে অসৎদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে তার কোনো দ্বিধা-সংশয় ছিল না।
মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি রাজধানীকে যানজটমুক্ত করার জন্য বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদের জন্য মেয়রের নেতৃত্বে অভিযানকালে ট্রাকচালক-শ্রমিকদের মুহুর্মুহু ইটপাটকেল বর্ষণে আনিসুল হকের জীবন বিপন্ন হয়েছিল। যথাসময়ে পুলিশ না এলে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। আনিসুল হকের এ উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত অর্থহীন হয়ে পড়ে- রাজপথ আবার ট্রাক ড্রাইভার-শ্রমিকদের দখলে চলে যায়। এ প্রসঙ্গে একটি দাবি আমি তুলতে চাই- সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত সড়কটির নাম ‘আনিসুল হক সড়ক’ করা হোক। আনিসুল হকের আরেক স্বপ্ন ছিল, রাজধানীর হারানো খালগুলো উদ্ধার।
এ লক্ষ্যে সমকালের সুহৃদ সমাবেশের উদ্যোগে গত ১ এপ্রিল আয়োজিত নদী অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন আনিসুল হক। তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেছিলেন :সন্তানের কাছে মায়ের দুধ যেমন প্রয়োজনীয়, নদীর পানিও ভূমির জন্য তেমনই। একসময় বলা হতো নদীমাতৃক বাংলাদেশ। সেই নদী আজ হারিয়ে যাচ্ছে। ডিএনসিসি এলাকায় ২৬টি খাল থাকার কথা। বৃষ্টির পানি খাল দিয়েই নদীতে চলে যাওয়ার কথা ছিল। সেই খাল ও নদী হারিয়ে গেছে। এখন ডিএনসিসি এলাকার জলজট নিরসন করাই মেয়রের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির পানি এখন আর নদীতে যায় না। দখলদাররা নদী দখল ও ভরাট করেছে। আজ ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহরে পরিণত হয়েছে। দূষণের কারণে ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস নষ্ট হচ্ছে। আজ শিশুপুত্রের কবরে শেষ শয্যা আনিসুল হকের। একদা তার দেহ মাটিতে বিলীন হয়ে যাবে। তবে আমাদের স্মৃতি থেকে কখনও হারিয়ে যাবেন না আনিসুল হক।
সম্পাদক-সমকাল