নাবিল ফারহান-সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের শুরুতে। বছর শেষ হওয়ার আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের মধ্যদিয়ে দেশে এক ধরনের নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রার্থী বাছাইয়ের জরিপ চালানো হচ্ছে। অপর দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সাথে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ক্ষমতাসীন-বিরোধী উভয় দল ও জোটের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হবে। সেভাবে দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। অপর দিকে বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে গত ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ধরনের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন ও ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। যদি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা শুরু হয় সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে সামনে রেখে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা হবে। আর যদি সরকার আলোচনায় না বসে তাহলে জনগণের সামনে রূপরেখা তুলে ধরে আন্দোলনে নামবে বিরোধী জোট।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। দীর্ঘদিন বিদেশে চিকিৎসা শেষে ঢাকায় ফিরে বিএনপি চেয়ারপারসন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। তার উপস্থিতিতে ব্যাপক জনসমাগম হচ্ছে। বিশেষ করে কক্সবাজার সফর ও ঢাকায় সরকারি বাধার মুখে সভায় যে বিপুল মানুষের সমাগম হয়েছে তাতে বিএনপির নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়ে উঠছেন।
আগামী জানুয়ারির মধ্যে বিভাগীয় শহরগুলোতে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থাৎ জনসমাবেশের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা ও সরকারবিরোধী জনমত গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, সরকারের মনোভাবের ওপর নির্ভর করবে আন্দোলনের কর্মসূচি। যদি সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে যায় তাহলে কর্মসূচি হবে এক রকম আর যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয় তাহলে কর্মসূচি হবে ভিন্ন রকম।
এ দিকে ক্ষমতাসীন দল এখন পর্যন্ত সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনড় অবস্থানে আছে। তবে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কৌশল ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সাথে আলোচনার পথ পুরোপুরি রুদ্ধ করতে চায় না ক্ষমতাসীন দল। এক ধরনের দরকষাকষির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। বিএনপি সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীকে বহাল রেখে নির্বাচনে যেতে রাজি হবে না। কিন্তু এসব পরিবর্তন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের চাপ সৃষ্টির সক্ষমতা কতটুকু আছে তা দেখতে চায় ক্ষমতাসীন দল।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই দলের এ বিপরীতমুখী অবস্থানে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, দুই পক্ষ অনড়। আওয়ামী লীগ সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করবে না। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচন করবে না। অপর দিকে বিএনপি শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে অংশ নেবে না। দুই দলের মধ্যে আপসের সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। তিনি মনে করেন, শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তার মতে শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে আবার রাজপথে ফিরে যেতে হতে পারে। এর ফলে দেশ আরেক দফা অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়বে এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপস্থিতিতে ব্যাপক জনসমাগম ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। নির্বাচন যে প্রক্রিয়ায়ই হোক না কেন নির্বাচনের আগে সভা-সমাবেশের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আবার বিরোধী দল এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে এগিয়ে গেলে পরিস্থিতি সামলানো সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির সভা-সমাবেশ নিয়ে সতর্ক ক্ষমতাসীন দল।
সরকার নানা মুখী অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে রয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানোর মধ্যদিয়ে বিচার বিভাগের সাথে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল তা আপত অবসান হওয়ায় সরকারের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সরকারের অস্বস্তি কাটছে না। বিশেষ করে বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও ভারতের ভূমিকা সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের সাথেও বিভিন্ন ইস্যুতে কিছুটা শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে।
ভারতের একজন মন্ত্রী বাংলাদেশকে তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্র ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ভারতের মনোভাবের ওপর সরকার গভীর দৃষ্টি রাখছে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের সাথে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়তে থাকবে। এ ধরনের চাপ মোকাবেলা করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য কতটা ছাড় দিতে পারবে ক্ষমতাসীন দল তা এখন দেখার বিষয়। কারণ দুই দলের অনড় মনোভাব দেশকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।