এবনে গোলাম সামাদ-হিন্দু ধর্ম অনেক দিক থেকেই অন্য ধর্মের মতো নয়। বিখ্যাত মার্কিন নৃতাত্ত্বিক এ এল ক্রোয়েবার (১৮৭৬-১৯৬০), তার বহুল পঠিত অ্যানথ্রোপলজি নামক গ্রন্থে হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন : যে অর্থে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ইসলাম একটি ধর্ম, হিন্দু ধর্মকে ঠিক সেই অর্থে ধর্ম বলা যায় না। কেননা, এই ধর্মের কোনো একজন প্রবর্তক নেই। এর মধ্যে নেই কোনো গোছালো বিশ্বাসের বুনিয়াদ। বিদেশীকে হিন্দু ধর্ম এড়িয়ে যেতে চায়; চায় না গ্রহণ করতে।
হিন্দু ধর্ম তাই প্রচার করা চলে না। অন্য কেউ পারে না হিন্দু হতে। হিন্দু ধর্মের মধ্যে কোনো বিশ্বজনীন আবেদন নেই। হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ক্ষিতিমোহন সেন তার বহুল পঠিত ইংরেজি ভাষায় লিখিত হিন্দুইজম বইতে হিন্দু ধর্মকে তুলনা করেছেন বনের সাথে। বন কেউ পরিকল্পনা করে তৈরি করে না। বন গড়ে ওঠে আপনা থেকেই। বনে থাকে নানা রকম গাছ। কিন্তু এই রকমারিকে ছাড়িয়ে বনের থাকে একটা সাধারণ রূপ। হিন্দু ধর্মেরও তা আছে। সেই রূপ দিয়েই এর পরিচয়।
ক্ষিতিমোহন সেনের হিন্দুইজম হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে একটি ভালো বই। সেটি পড়লে অনেক কিছু জানা যায়। তবে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ কোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। ভারতে হিন্দু বিবাহ আইন পাস হয় ১৯৫৫ সালে। এই আইনে বলা হয়েছে, যারা মুসলমান, পারসিক, খ্রিষ্টান অথবা ইহুদি নয়, তাদের সবাইকে ধরতে হবে হিন্দু। আর তাদের সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে হিন্দু বিবাহ আইন। ভারতে মুসলিম জীবন এখন নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছে শরিয়াহ আইন অনুসারে। সেখানে সবার জন্য এক আইন করা সম্ভব হয়নি, যদিও বলা হয় ভারত একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। হিন্দুদের কাছে গো-মাতা পূজনীয়। তাই ভারতের বেশির ভাগ প্রদেশে গো-মাংস ভক্ষণ আইনত করা হয়েছে নিষিদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা হলো সম্ভবত এর বিশেষ ব্যতিক্রম। আমরা হিন্দু ধর্ম বলতে বুঝছি গো-ব্রাহ্মণে বিশেষ ভক্তি। একে আর এক কথায় হিন্দু ধর্ম না বলে ব্রাহ্মণ্যবাদও বলা যেতে পারে।
ইসলাম একটি লিখিত ধর্ম। আল কুরআন এর মূল ভিত্তি। এতে মূর্তি পূজা নেই। নেই উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের ধারণা। এতে বিধৃত হয়েছে মানব সমতাবাদের বাণী। যে কারণে ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে আরবের হেজাজ থেকে বিশ্বের নানা অঞ্চলে। ইসলাম একটি প্রচারশীল ধর্ম। এর মধ্যে আছে একটা বিশ্বজনীন আবেদন ও পরিচ্ছন্ন জীবনবোধ। না হলে ইসলাম এত দ্রুত বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়া কখনো সম্ভব হতো না। কেবল তরবারির জোরে এই ধর্মবিশ্বাস পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়েছে, এ রকম ভাবা যায় না। কেননা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু মুসলমানের বাস। আর এখানে ইসলাম বিস্তারের মূলে কাজ করেছে ইসলাম প্রচারকদের প্রচারণা। কেননা, ওই অঞ্চলের ইতিহাসে বাইরে থেকে মুসলমান গিয়ে রাজ্য স্থাপনের ঘটনা ঘটেনি; যেমন ঘটেছে এই উপমহাদেশে।
বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা এখনো হয়নি। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয়, এর সূচনা হতে পেরেছিল খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে, মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুর্কি মুসলিম অভিযানের ফলে। সাঁওতালরা মুসলমানদের তাদের ভাষায় বলে ‘তুরুক’। অর্থাৎ তুর্কি। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে মিথিলার (বর্তমান বিহারের ত্রিহুত) কবি বিদ্যাপতি তার ‘কীর্ত্তিলতা’ লিখেছেন :
হিন্দু তুরুকে মিলল বাস।
একক ধম্মে অওকো উপহাস ॥
কতহুঁ বাঙ্গ কতহুঁ বেদ।
কতহুঁ মিলমিস কতহুঁ ছেদ ॥
এখানে লক্ষ করার বিষয়, বিদ্যাপতি মুসলমানদের বলছেন তুরুক বা তুর্কি। তিনি আরো বলছেন, হিন্দুদের মধ্যে অনেক বিভেদ। কিন্তু তুরুকের মধ্যে তা নেই। তুরুক ও হিন্দু পাশাপাশি বাস করলেও তারা একে অপরের ধর্মকে উপহাস করে। তুরুকরা দেয় আজান (বাঙ্গ)। আর হিন্দুরা বলে বেদের কথা। কিন্তু এখন কেবল বাইরে থেকে আগত তুর্কি মুসলমান কর্তৃক বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসকে যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে না। কেননা, নওগাঁর বিখ্যাত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশিদের মুদ্রা। পরবর্র্তীকালে দু’জন আব্বাসীয় খলিফার মুদ্রা মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে কুমিল্লার বিখ্যাত ময়নামতি বৌদ্ধবিহারে। তাতেই অনেকে মনে করেন, সমুদ্রপথে আরব মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপিত হতে পেরেছিল। এর ফলে আরব মুসলিম বিশ্ব থেকে ইসলাম এসে পৌঁছেছিল বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে, তুর্কি মুসলমান আসার অনেক আগেই। তবে এভাবে ইসলাম কতটা প্রচার হতে পেরেছিল, সেটা নিয়ে আছে সংশয়।
অন্য দিকে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সুমাত্রায় মিনাঙ্কাবু (Minangkabau) নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মুসলিম সালতানাত। এই সালতানাত থেকে ইসলাম প্রচারিত হয় ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য জায়গায় এবং মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের ছিল বিশেষ বাণিজ্যিক যোগাযোগ। তাই এই অঞ্চল থেকেও ইসলামের একটা প্রভাব এসে থাকতে পারে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে ইসলাম গ্রহণ করেছিল বৌদ্ধরা। তেমনি বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। বাংলাভাষী মুসলমান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের মতোই লুঙ্গি পরে। একসময় হিন্দুরা লুঙ্গিকে মুসলমানি পোশাক বলে ঘৃণা করেছে; পরতে চায়নি। সেটা খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এখন বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মিলে যত মুসলমানের বাস, বিশ্বের আর কোনো অঞ্চলে এত মুসলমান বাস করে না।
বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ অনেকেই চাকরি করতে চাচ্ছে মালয়েশিয়ায়। তারা সেখানে বেশ ভালো বেতন পাচ্ছে। এসব কথা বলছি এক কারণে যে, ভারতের অনেক পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে (দ্রষ্টব্য : দেশ পত্রিকা, চিঠিপত্র বিভাগ; ২ জুলাই ২০১৭) বাংলাদেশ থেকে মুসলমানরা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি জনবহুল জায়গায়, যেখানে সে দেশের মানুষেরই হতে পারছে না কর্মসংস্থান, সেখানে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানরা যেতে চাচ্ছে কেন, তার ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, অনেক মুসলমান যাচ্ছে, যারা বেশ বিত্তবান। এরা প্রধানত যাচ্ছে কলকাতায়। কলকাতায় কিনছে বাড়ি ও জায়গাজমি। এভাবে যদি তারা কলকাতায় বাড়ি ও জায়গাজমি কিনতে থাকে, তবে কলকাতা শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমানদের হাতে। বাঙালি হিন্দুদের হাতে থাকবে না কলকাতা শহরের নিয়ন্ত্রণ, যদিও কলকাতা শহর হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী।
কিন্তু একটা বেসরকারি জরিপ অনুসারে কলকাতা শহরের কর্মক্ষম জনসমষ্টির শতকরা ৫৪ ভাগ হলো ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে আসা। তাই বলা চলে না, কলকাতা শহর নিয়ন্ত্রিত হয় বাঙালি হিন্দুর দ্বারা। পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ মুসলমানের মাতৃভাষা হলো বাংলা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ৬ ভাগ হিন্দুর মাতৃভাষা হলো হিন্দি। পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে ধনী জনসমষ্টি হলো মাড়ওয়ারি যাদের মাতৃভাষা হিন্দি। এদের পূর্বপুরুষ এসেছে ভারতের রাজস্থান থেকে। আর এরা এখনো অনেকেই বিবাহ করতে যায় রাজস্থানে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি তাই বলতে হয়, রাজস্থানি নিয়ন্ত্রিত। পশ্চিম বাংলার কলকারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করে, তাদের অধিকাংশই অবাঙালি হিন্দু। এরা বাড়িতে টাকা পাঠায়। ফলে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ থেকে যত টাকা প্রতি বছর ভারতের অন্য প্রদেশে যায়, ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে সেই পরিমাণ অর্থ পশ্চিমবঙ্গে আসে না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে এভাবে টাকা আসার কথা আমাদের জানা নেই।
বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে যখন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান যাওয়াকে উৎসাহিত করেছে। কারণ তারা ভেবেছে, এভাবে মুসলমান গেলে বাড়বে তাদের ভোট। এখন বলা হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একই কারণে নাকি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান যাওয়াকে উৎসাহিত করছেন। কিন্তু কেবল ভোট দেবার জন্য মুসলমানেরা পশ্চিম বাংলায় গিয়ে কী করবে; সেখানে যদি তাদের রুজি-রোজগারের কোনো ব্যবস্থা না হয়? পশ্চিমবঙ্গে এখন যে ধরনের মুসলমানবিরোধী প্রচার চলেছে, তাতে সেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। আর সেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক খারাপ হলে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অবশ্যই খারাপ হতে পারে। এটা বর্তমান বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভারতের কাম্য হতে পারে না।
পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসমষ্টির ২৫.২ শতাংশ হলো মুসলমান। এত মুসলমান বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাওয়া অকল্পনীয়। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান আগেও যথেষ্ট ছিল। এসব মুসলমান মূলত হলো তাদেরই বংশধর। এরা বাইরে থেকে আসা নয়। খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তার কবিকঙ্কন চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে তার সময়ের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মুসলমানদের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে :
ফজর সময়ে উঠি বিছায় লোহিতপাটী
পাঁচ বেরি করয়ে নমাজ।
সোলেমানি মালা ধরে জপে পীর পেকম্বরে
পীরের মোকামে দেয় সাঁজ ॥
দশ-বিশ বিরাদরে বসিয়া বিচার করে
অনুদিন পড়য়ে কোরান।
কেহ বা বসিয়া হাটে পীরের শিরিনি বাঁটে
সাঁঝে বাজে দগড় নিশান ॥
বড়ই দানিশমন্দ কারে নাহি করে ছন্দ
প্রাণগেলে রোজা নাই ছাড়ি।
ধরয়ে কাম্বোজ-বেশ মাথায় না রাখে কেশ
বুক আচ্ছাদিয়া রাখে দাড়ি ॥
মুকুন্দরাম বলছেন, মুসলমানেরা হলো খুবই জ্ঞানী (দানিশমন্দ)। তারা কারো সাথে ছলচাতুরী করে না। নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ দেখা দিলে তারা নিজেরাই তার বিচার করে নিষ্পত্তি করে। তারা মাথা ন্যাড়া করে; কিন্তু বুকজোড়া দাড়ি রাখে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা নিশ্চয় আর এ রকম মুসলমান নয়। কিন্তু ভাবা চলে মুকুন্দরাম যেমন মুসলমানদের বর্ণনা করেছিলেন, এরা হলো তাদেরই বংশধর। এরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমান নয়। পশ্চিমবঙ্গে আগেও মুসলমান ছিল আর এখনো আছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বলা হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খাঁটি ব্রাহ্মণ ঘরের কন্যা হলেও এখন আর খাঁটি হিন্দু নন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন। ইসলামের ইতিহাস পড়তে গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন ইসলামি মনোভাবাপন্ন। তিনি হয়ে উঠেছেন ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী যার ভিত্তিতে তিনি গড়তে চাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গকে। তাই পশ্চিমবঙ্গে যদি হিন্দুত্ব বজায় রাখতে হয়, তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপার। আমরা এ সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে যদি শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে আমরা বাংলাদেশের মুসলমান অবশ্যই ক্ষুব্ধ হবো।