নিশাত সুলতানা-ছোটবেলায় একবার মায়ের পেঁয়াজ কাটা দেখে প্রচণ্ডভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বাটিতে কেটে রাখা পেঁয়াজকুচিগুলো যেন পেঁয়াজ নয়, ঝরে পড়া সাদা চন্দ্রমল্লিকার পাপড়ি। পেঁয়াজ কাটতে চাইলে মা বলেছিলেন, ‘পেঁয়াজ থেকে দূরে থাক। পেঁয়াজে বড্ড ঝাঁজ!’ মায়ের কথা সেদিন শুনিনি। তবে জীবনের এতগুলো বছর পার করে এখন একটু অন্যভাবে বুঝি, মায়ের সেদিনের কথা কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল। তাই হয়তো আজও পেঁয়াজের ঝাঁজে প্রায়ই কাবু হতে হয় আমায়। তবে পেঁয়াজের নিজস্ব ঝাঁজ যতটা না আমায় কাবু করে, তার চেয়ে ঢের বেশি কাবু করে পেঁয়াজের দামের ঝাঁজ। অন্যদিকে, পেঁয়াজও তার উদারতা থেকে কখনো আমায় বঞ্চিত করেনি। সে তার স্বমূর্তিতে হাজির হয়েছে প্রতিটি ঋতুতে নানান রূপে, নানান ঝাঁজে আর নানান দামে। প্রতিদিনের রান্নায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান যে কতটা বৈচিত্র্যময় দামে বাজারে উপস্থাপিত হতে পারে, পেঁয়াজ তার উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত।
দেশি পেঁয়াজের ঝাঁজ আরও বেশি। তাই কি তার দামও বেশি? পেঁয়াজ একদিকে যেমন চোখের পানির বন্যা বইয়ে দিতে সক্ষম, অন্যদিকে তা আবার হাতের এবং নখের সৌন্দর্যের বারোটা বাজাতেও অনন্য। তারপরও সে পেঁয়াজ! পেঁয়াজ না হলে আমাদের চলেই না! এর প্রয়োজন এতটাই বেশি যে তাকে রান্নাঘর থেকে বয়কট করে, এমন সাধ্য কার! পেঁয়াজ কাটার কষ্ট থেকে গৃহিণীকে মুক্তি দিতে বাজারে এসেছে প্রযুক্তিনির্ভর নানান যন্ত্র। এসব যন্ত্র নিমেষেই কেটে টুকরো টুকরো করে দিতে সক্ষম প্রতাপশালী পেঁয়াজকে। এই যন্ত্রগুলো একদিকে যেমন গৃহিণীর হাতকে বাঁচায় কালচে দাগ থেকে, অন্যদিকে তা মুক্তি দেয় কর্তনকারীকে পেঁয়াজের ঝাঁজে কান্নাকাটি করার যন্ত্রণা থেকে। তবু পেঁয়াজের এ ঝাঁজ লোকে ভালোবাসে। কারণ, রান্নার স্বাদ বাড়াতে পেঁয়াজের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু মাঝেমধ্যেই লাগামহীন হয়ে ওঠা পেঁয়াজের দামের ঝাঁজ থেকে ভোক্তাকে মুক্তি দেবে কে? ভোক্তার কাছে পেঁয়াজের এই ঝাঁজ যে অসহনীয়!
মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা আমি ছোটবেলায় লক্ষ্য করেছি, পেঁয়াজের সস্তা সময়ে ঘরে ঘরে পেঁয়াজের ক্ষুদ্র আড়ত গড়ে উঠতে। তবে এই ক্ষুদ্র আড়ত পেঁয়াজের দুর্মূল্যের সময়ে তেমন কোনো কাজে দিত বলে মনে পড়ে না। সেই আড়তে রক্ষিত পেঁয়াজ সাময়িকভাবে মা-খালাদের মনে প্রশান্তি জোগালেও কদিন পর তা দুশ্চিন্তায় রূপ নিত যখন সেখানে আক্রমণ করত ইঁদুরের দল। কিংবা পেঁয়াজ পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে তা দুর্বিষহ করে তুলত গৃহবাসীর জীবন। অগত্যা বাস্তবায়ন করা হতো সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে পেঁয়াজ শেষ করার কর্মসূচি। সেও এক কষ্টকর প্রক্রিয়া। প্রতিবেলায় শুধু পেঁয়াজ সহযোগে ভুনা মাছ-মাংস কিংবা দোপিঁয়াজা আর চচ্চড়ি ভোজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হতো পরিবারের সবাই।
প্রায়ই আমি ভাবি, শহরের বাসাবাড়িতে পেঁয়াজ জমিয়ে রাখার যদি সহজলভ্য কোনো পদ্ধতি থাকত! গত বছর খাগড়াছড়ি জেলায় কাজের প্রয়োজনে গিয়ে স্থানীয়দের রোদে মুলা শুকানোর অনন্য পদ্ধতি আমার নজর কেড়েছিল। মনে হয়েছিল, আহা, যদি পেঁয়াজকেও এভাবে রোদে শুকিয়ে কৌটায় ভরে রাখা যেত! কিন্তু জানি তা হওয়ার নয়। সূর্যের তাপ মুলার জলীয় অংশ ও ঝাঁজকে শোষণ করে তাকে সারা বছর খাওয়ার উপযোগী করে রাখলেও পেঁয়াজকে বশে এনে শুকিয়ে সারা বছর ব্যবহারের উপযোগী করে রাখতে অক্ষম সূর্যমামা।
কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম যখন ১০০ টাকা ছাড়ায়, তখন তা হয়ে ওঠে সেঞ্চুরিয়ান পেঁয়াজ। প্রতিদিনের রান্নার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়েও পেঁয়াজ তখন হয়ে ওঠে অচেনা কোনো এক সুপারস্টার, যার নাগাল নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত পরিবার পায় বটে, তবে অন্য কোনো প্রয়োজন বিসর্জনের বিনিময়ে। গৃহিণী কড়াইয়ে কিংবা ফ্রাই প্যানে পেঁয়াজ ঢালেন, আর মনে মনে ভাবেন, কত টাকা তেলে ফেলছেন তিনি। অনেকে চেষ্টা করেন সেই দিনগুলোয় পেঁয়াজবিহীন রান্নার কলাকৌশল আয়ত্ত করতে। কিন্তু পেঁয়াজের স্বাদ কি আর অন্য কিছুতে মেটে!
এই যে পেঁয়াজ নিয়ে প্রতিবছর এত দুর্গতি আর হই-হট্টগোল, তারপরও পেঁয়াজের একরোখা চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয় না। পেঁয়াজ সত্যিই বড্ড একগুঁয়ে। আসুন, আমরা পেঁয়াজের এই একগুঁয়ে স্বভাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। পেঁয়াজকে বশে আনতে একযোগে প্রতিটি বাড়ির বারান্দার ও ছাদের প্রতিটি টবে পেঁয়াজ চাষ শুরু করি এবং থরে থরে উৎপাদন করা শুরু করি পেঁয়াজ। আমরা সবাই পেঁয়াজচাষি হই। শহরাঞ্চলের ফেলে রাখা জমি, ছাদ, বারান্দায় সবজি চাষের প্রচলনে মনে হয় কিউবার রাজধানী হাভানা সেরা। সেটা আমরা করতেই পারি। এটা হলো নিরুপায়ের উপায়। কিন্তু এতে তো আমাদের বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটার নয়। আমাদের ভাবা উচিত, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা মানে আসলে কী? একদিকে রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে উৎসাহ দেব, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানির কাছে জিম্মি হয়ে থাকব, এটি কি কোনো ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তবতা? খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা মানে তো নিজেদের চাহিদা নিজেরাই মেটানোর যোগ্যতা অর্জন করা। আমদানিমুখী খাদ্যনিরাপত্তা কেমন নিরাপত্তা, তা পেঁয়াজের ঝাঁজে আর চালের দামের গরম কি হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে না? পেঁয়াজের জিম্মি জনসাধারণ এর একটা প্রতিকার চায়।
এই প্রক্রিয়ায় একদিকে আমরা যেমন পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারব, অন্যদিকে এর মাধ্যমে আমরা সরকারের বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহামান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আরও দীর্ঘ সময় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে সহায়তা করতে পারব। পরিশেষে তাদের সুখনিদ্রা হোক আরও দীর্ঘস্থায়ী ও পেঁয়াজের ঝাঁজমুক্ত!
(লেখায় ব্যক্ত মতামত লেখকের নিজস্ব)
নিশাত সুলতানা: কর্মসূচি সমন্বয়ক। জেন্ডার, জাস্টিস ডাইভার্সিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক
purba_du@yahoo.com