বিশেষ প্রতিনিধি-একাগ্রতা ও নিষ্ঠা কীভাবে একজন মানুষকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্যের শিখরে উঠতে সাহায্য করে তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান খান। উদ্যোক্তা হিসেবে হোটেল ব্যবসায় তাঁর সাফল্য প্রবাসে ও দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ বিশেষ।
বর্তমানে আমেরিকার অরেগন অঙ্গরাজ্যের পোর্টল্যান্ড নগরে বসবাসকারী মাসুদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্রকৌশল (মেকানিক্যাল) বিষয়ে ডিগ্রি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বুয়েটে ভর্তির পরই সেই পথে হাঁটা শুরু করেন।
মাসুদ বলেন, বুয়েটে ভর্তি হয়ে প্রথম বছরেই তিনি কিছু সহপাঠীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় কোচিং সেন্টার খোলেন। এ সময় থেকেই তিনি বই লিখে সেগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এই দুটি তিনি ব্যবসা নয়, ‘শখ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৯৯৬ সালে বুয়েট থেকে পাশ করে তিনি ঢাকায় পেট্টোবাংলায় দুই বছর চাকরি করেন। ১৯৯৯ সালে আমেরিকায় এসে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে যন্ত্রকৌশলে (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)¯স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ২০০২ সালে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েট নগরীতে টয়োটা কোম্পানিতে চাকরি নেন। চার বছর পর তিনি জেনারেল মোটরসে যোগ দেন। ২০০৯ সালে তিনি জেনারেল মোটরস ছেড়ে সরাসরি হোটেল ব্যবসায় নামেন।
উত্তর আমেরিকা থেকে এক সাক্ষাৎকারে মাসুদুর রহমান বলেন, ‘অন্যের অধীনে চাকরি না করে নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। গৌরবময় মনে করি। মিশিগানে কাজ করে কিছু অর্থ জমা হওয়ার পর আমিসহ বুয়েটের পাঁচজন প্রকৌশলী মিলে ২০০৪ সালে ১৯ লাখ ডলার দিয়ে একটি হোটেল খরিদ করেন। পরে ২৪ লাখ ডলার দিয়ে আরেকটি হোটেল কেনেন। মিশিগানে চাকরি ও ব্যবসায় ভালোভাবেই চলছিল।’
কিন্তু মাসুদের স্ত্রী ড. তাসলিমা সুলতানা সুমি ইনটেল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে পোর্টল্যান্ডে চলে যাওয়ায় তিনিও মিশিগানে চাকরি ও ব্যবসা ছেড়ে ২০০৯ সালে পোর্টল্যান্ডে চলে যান। একই বছর পোর্টল্যান্ডে ‘ইন্ অ্যাট সী সাইড’ নামে একটি হোটেল ২৫ লাখ ডলারে কিনে নেন। হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিজেই দায়িত্ব নেন। এতে খুব ভালো সাফল্য আসায় তিনি হোটেল ব্যবসাকেই তার স্থায়ী পেশা হিসেবে বেছে নেন।
বর্তমানে অরেগন রাজ্যে তিনি ১০টি হোটেলের মালিক ও অংশীদার। ১০টি হোটেলই সাগর পাড়ে। চারটি আবার একেবারেই প্রশান্ত মহাসাগরের সৈকতে। আর ছয়টি থেকে ২/৩ মিনিট হাঁটলেই সমুদ্র সৈকত।
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মাসুদুর রহমান বলেন, ২০১২ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের একেবারেই কাছে এবং নেকানিটাম নদীর তীরে একটি জমি কিনে নিজেই সেখানে ৪৮ কক্ষবিশিষ্ট বুটিক হোটেল নির্মাণ করেন। এতে জমিসহ মোট পাঁচ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। কেবল উদ্যম, অধ্যবসায়, সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে মাত্র আট বছরের মধ্যে মাসুদ ১০টি হোটেলের মালিক কিংবা অংশীদার হতে সক্ষম হয়। প্রতিটি হোটেলে তার কমপক্ষে ২৫ শতাংশ অংশীদারত্ব রয়েছে। সব অংশীদারই বুয়েট থেকে পাস করা প্রকৌশলী।
মাসুদের হোটেল ‘রিভার ইন্ অ্যাট সী সাইড’ ২০১৭ সালে পুরো আমেরিকার ‘ইনডিপেনডেন্ট’ হোটেলগুলোর মধ্যে ‘হোটেল অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড’ অর্থাৎ বছরের সেরা হোটেল হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। আমেরিকাতে এ ধরনের প্রায় ১০ হাজার হোটেল রয়েছে। অন্যদিকে হোটেল ব্যবসায় সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে তিনি ‘অরেগন স্টেট হোটেল অপারেটর অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০১৪ সালে অরেগনের ‘ক্যাল্টশপ কাউন্টি’ থেকে ‘বিজনেস ইন্টারপ্রেনর অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘সী সাইড রোটারি ক্লাব’ থেকে বিজনেস ইথিক্স অ্যাওয়ার্ড; ২০১৫ সালে ‘সী সাইড চেম্বার এ- কমার্স’ থেকে ‘করপোরেট বিজনেস অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১৬ ও ১৭ সালে পরপর দুই বছর ‘অরেগন বিজনেস কমিউনিটি’ থেকে ‘বেস্ট হান্ডের্ড ডেসটিনেশন র্যাঙ্কিং’ উপাধি পান।
তিন কন্যা-সন্তানের জনক মাসুদুর রহমান বলেন, ‘মাত্র ১০ জন কর্মচারী নিয়ে তিনি প্রথম হোটেল ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে কর্মচারীর সংখ্যা ২০০। এ সাফল্য আমাকে আনন্দ দেয়। আমি প্রত্যেক কর্মীকে আমার পরিবারের সদস্য বলে মনে করি। এদের সঙ্গে কাজ করে আমি আনন্দ পাই।’
মাসুদ বলেন, পোর্ট নগরীর উন্নয়নমূলক কাজে আমি সক্রিয় ভূমিকা রাখছি। আমি বিভিন্ন কমিউনিটির সেবামূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত। তাদের আমি আর্থিক সহযোগিতা দিই। আমি আয় করে শুধু আমার পকেটে রাখি না। কমিউনিটির বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আমি স্থানীয় জনগণকে আর্থিক সমর্থন দিয়ে থাকি।’
নতুন প্রজন্মের প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রসঙ্গ উঠতেই মাসুদুর রহমান খান বলেন, অধ্যয়ন বা চাকরির পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে কোন ব্যবসা শুরু করা উচিত। তিনি তাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করার পরামর্শ দেন। যে কাজটি করার ইচ্ছা জাগে সে কাজটি দিয়েই শুরু করতে হবে। তিনি নতুন প্রজন্মকে স্বদেশে ও প্রবাসে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সব কাজই ‘চ্যালেঞ্জের ও পরিশ্রমের’, কিন্তু লেগে থাকলে অধ্যবসায়ী হলে সাফল্য আসবেই।
প্রবাসে এ ধরনের সাফল্যের পেছনে কারও অবদান রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী মাসুদ বলেন, ‘অবশ্যই আমার মা-বাবার দোয়া রয়েছে। আর আমার স্ত্রীর অবদান এবং উৎসাহই মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আমি ব্যবসায় নেমে সঠিক কাজই করছি বলে আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’
বাংলাদেশের জন্য কী ভাবছেন জানতে চাইলে বাংলাদেশি এই প্রকৌশলী বলেন, সব সময়ই দেশের জন্য ভাবেন। দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছাও রাখেন। তিনিসহ চার বন্ধু মিলে কুয়াকাটায় চার একর জমি কিনেছেন। ওই জমিতে আমেরিকার আদলে হোটেল নির্মাণ করে আমেরিকার অভিজ্ঞতাকে বাংলাদেশে প্রয়োগ করবেন তাঁরা।