হাসান শরীফ-দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসকদের খাবার-দাবার কেমন হয়? সম্রাট নেপোলিয়নের রান্নাঘরে নাকি কখনো চুলা নিভত না। সবসময় মুরগি রান্না হতো। সম্রাট যখনই চাইবেন, সাথে সাথে তাকে গরম গরম মুরগির গোশত পরিবেশন করার নির্দেশ ছিল। সম্রাট আকবর সম্পর্কেও এমন কথা চালু আছে। রাত দুপুরেও নাকি তার সামনে ৩২ পদ হাজির করতে হতো। এত গেল সেই আমলের কথা।
এখনকার, এই আধুনিক সময়ের শাসকদের ডাইনিং টেবিলটি কিভাবে সাজানো থাকে? এই যেমন যোশেফ স্ট্যালিন, সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফিরা কী খেতেন, কিভাবে খেতেন? এ নিয়ে কৌতূহল আছে অনেকের। তাদের তৃপ্ত করতেই হাজির হয়েছে একটি বই : ‘ডিক্টেটর্স ডিনার্স : অ্য বেড টেস্ট গাইড টু এন্টারনেইনিং টাইরেন্টস’। লিখেছেন ভিক্টোরিয়া ক্লার্ক ও মেলিসা স্কট।
মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তিদের খাবার-দাবার সম্পর্কে কিছু বলার আগে আরেকটি কথা জানিয়ে রাখা দরকার, তা হলো, চূড়ান্ত ক্ষমতাই লোকজনকে যা ইচ্ছা খেতে উৎসাহিত করে নাকি সময়ের পরিক্রমায় আতঙ্কে শাসন পরিচালনার বিষয়টিই তাদেরকে খাবার টেবিলে স্বেচ্ছাচারী বানিয়ে দেয়, তা বলা মুস্কিল। খুব সম্ভবত তাদের ক্ষেত্রে দুটিই প্রযোজ্য। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আপনি যখন এসব স্বৈরাচারের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে পড়বেন, অত্যন্ত নৃশংসভাবে দেশবাসীর ওপর তাদের শাসন প্রয়োগ নিয়ে সামান্য হলেও বাড়তি কিছু জানতে পারবেন।
ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের কথাই ধরা যাক। তিনি স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যাপারে তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকার কথা প্রায়ই বলতেন। কিন্তু তবুও দেখা যায়, বিশেষ ধরনের চকোলেট, ক্যান্ডির প্রতি তার লোভ দিন দিন বাড়ছিল। অনেক অতিথিই তার চকোলেট প্রীতির কথা জানিয়েছেন। এমনকি মার্কিন অভিযানের পর তিনি যখন পালিয়ে বেড়াতেন এবং তাকে যখন গোপন স্থান থেকে আটক করা হয়, তখনও তার সাথে বিপুল চকোলেট ছিল।
সাধারণভাবে বেশির ভাগ দাপুটে শাসককে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক ভাগে থাকবেন স্বাস্থ্যসচেতনরা, অন্যভাবে খাবারের ব্যাপারে বেপরোয়া। টিটো, মবুতু, ইদি আমিন ও স্ট্যালিনদের খাবার টেবিলে এক গ্রুপে রাখা যায়। তারা তাদের নিম্নপদস্থ এবং অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে ভোজসভাকে ব্যবহার করতেন অস্ত্র হিসেবে। স্ট্যালিনের টেবিলে জর্জিয়ার মুখরোচক খাবারগুলো শোভা পেত। ‘সাতসিভি’, ‘চিকেন-অ্যান্ড-ওয়ালনাট স্টু থাকতই। খাবার টেবিলে অংশগ্রহণকারীরা যাতে পানাহার ভালোভাবে করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা ছিল পরিবেশনকারীর প্রধান কাজ। অনেক সময় ভোর ৫টা পর্যন্ত চলত পান-পর্ব।
একবার এক ভোজপর্বের পর ক্রশ্চেভ বিছানা পর্যন্ত ভিজিয়ে ফেলেছিলেন। আর টিটু জ্যাকেটের হাতাতেই বমি করে দিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে মদ্যপানের বিষয়টাতে চার্চিল পর্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন, মিষ্টি লাল খবানচারা মদ তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক, এখানে উল্লেখ করতেই হয়, স্ট্যালিনের শেফদের একজন ছিলেন স্পিরিডন পুতিন, রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দাদা।
তবে ভোজসভায় অ্যান্টোনিও স্যালাজারের মতো চরম কৃচ্ছ-পরায়ণরা কী করতেন, তা কল্পনা করা সহজ নয়। এই পর্তুগিজ স্বৈরশাসক দুপুরের খাবার সারতেন মাছের কাটার স্যুপ দিয়ে। তিনি তার টোস্টে পর্যন্ত মাখন লাগাতেন না। বিপরীতক্রমে মুয়াম্মাদ গাদ্দাফি হজমের গণ্ডগোল থেকে রেহাই পেতে উটের দুধ পান করতেন। তবে হিটলার কেন এমনটা করতেন, তা বোধগম্য নয়। ক্লার্ক ও স্কট দাবি করেছেন, অব্যাহত গ্যাস নির্গমন ঘটত। আর সে কারণেই তিনি ছিলেন নিরামিশভোজী। গাদ্দাফির অবস্থাও এমনই ছিল। আর তা নিয়ে তিনি অস্বস্তিতে ছিলেন। জন সিম্পসনের বক্তব্য সেটাই বলছে।
আরেকটা ব্যাপারে, প্রায় সব স্বৈরশাসকের মধ্যে সন্দেহের বাতিক ছিল। তারা নিজেদের মতো করে মেনু পরীক্ষা করাতেন। চচেস্কু বিদেশে গেলে, সঙ্গে করে বহনযোগ্য ল্যাবরেটরিসহ তার কেমিস্ট নিয়ে যেতেন, তার খাবার পরীক্ষার জন্য। এমনকি একপর্যায়ে এই রোমানিয়ান স্বৈরশাসক নিজের বার্বুচি পর্যন্ত সাথে নিতেন। রাষ্ট্রীয় ভোজসভাগুলোতে চচেস্কু তার খাবার যত জোরে সম্ভব মেঝেতে আছড়ে ফেলতেন, তারপর সেটাকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিতেন। কেন করতেন তা কি কেউ জানে?