ফেনী
শুক্রবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৯:৫০
, ২৭শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি
শিরোনাম:
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৩ কিলোমিটার যানজট গৃহযুদ্ধের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৭৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা সমৃদ্ধ এশিয়া গড়তে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরির আহ্বান ড. ইউনূসের ফেনীতে গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারের মাঝে অনুদানের চেক বিতরণ বাংলাদেশকে করিডোর দিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহবান বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটি উত্তরা’র দোয়া ও ইফতার মাহফিল ইয়াং স্টার ক্লাবের দোয়া ও ইফতার মাহফিল ফরহাদ নগর ইউনিয়ন বিএনপির দোয়া ও ইফতার মাহফিল ফসলি জমির মাটিকাটা রোধে গভীর রাতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযান,এস্কেভেটর-ট্রাক জব্দ বালিগাঁওয়ে প্রতিপক্ষের বাধায় থমকে গেল ব্যবসায়ীর গৃহ নির্মাণ,হামলার অভিযোগ

ফাঁসির মঞ্চ থেকে শেখ মুজিবুরের দেশে প্রত্যাবর্তন

 

 

জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী-২৬ মার্চ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডন পৌঁছলেন। ঢাকার ধ্বংসযজ্ঞের আরো বিস্তারিত সংবাদ দেখলেন পরের দিন বিবিসি ও লন্ডন টাইমস পত্রিকায়।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬২ সালে। তখন তিনি পাকিস্তান হাইকোর্টের নবীন বিচারপতি। আমার ভাইয়ের শ্বশুর বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী তখন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। দেশে আইয়ুব খান-বিরোধী আন্দোলন চলছে। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে। আইয়ুব খান মোনেম খানের কোনো মন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা যাবে না। প্রধান বিচারপতিকে প্রধান অতিথি করার সিদ্ধান্ত হয়। আমি আপত্তি তুলি, কারণ তিনি অত্যন্ত রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থী প্রায় সামরিক সরকার ঘেঁষা। তাই তার পরিবর্তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জুনিয়র, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার টাঙ্গাইলের জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরীর সন্তান বর্তমানে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ব্যারিস্টার আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে একটি সুন্দর জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন, যা খুব প্রশংসিত হয়েছিল।

২৮ মার্চ আমি লন্ডনের বালহাম এলাকায় গিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করি। সামান্য পরিচয় দিতে উনি আমাকে চিনলেন, বললেন তিনি সত্বর ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন তার ছাত্রদের মারা হচ্ছে তার বিহীত করতে হবে। আমি বললাম, সর্বনাশ, এত বড় ভুল করবেন না। ঢাকায় প্রতিবাদ করতে গেলে আপনার জীবন নাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বরং আপনি লন্ডনে থেকে বাংলাদেশের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলুন। ব্রিটেনে আপনার উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন রয়েছে। প্রবাসী বাঙালিদের আপনি নেতৃত্ব দিন। প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উপদলে বিভক্ত। প্রগতিশীল বাম সংগঠনগুলো বিভিন্ন মতবাদে বিচ্ছিন্ন। আপনি হবেন সম্মিলিত প্রবাসী বাঙালিদের নেতা। তিনি হেসে বললেন, ‘গত দুই দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসেছিলেন এবং তাদের সাথে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছেন। আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছেন।’ বিচারপতি চৌধুরী ওই দিনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ইস্তফা দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বার্থে সব প্রবাসী বাঙালি একত্র করার মূল দায়িত্ব পালন শুরু করেন সক্রিয়ভাবে। শুরু হলো তার জীবনের সাধনা বাংলাদেশের সপক্ষে ব্রিটেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় জনমত সৃষ্টি এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানোর প্রাণপণ সাধনা।

চার মাস এপ্রিল থেকে জুলাই, বিচারপতি চৌধুরী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চরকির মতো ঘুরলেন এক শহর থেকে অন্য শহরে, দেখা করলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, ডিন এবং বিচারপতিদের সাথে। কয়েকবার হাজির হলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, সাক্ষাৎ করলেন মন্ত্রী ও ছায়ামন্ত্রীদের সাথে, দীর্ঘ আলোচনা করলেন রক্ষণশীল দলের নেতা স্যার জেরাল্ড নবারো ও রেভারেন্ড ইয়ান পেইসলি এবং বামপন্থীদের কণ্ঠস্বর ইয়ান মিকার্ডো ও অ্যান্ড্রু ফাউলসের সাথে।

আবু সাঈদ চৌধুরী একাধারে বিচারপতি, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিধায় গণ্যমান্য সবার সাথে সাক্ষাৎ করা তার জন্য সহজ হয়েছিল। ২৪ এপ্রিল তার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতায় বিলেতের কভেন্ট্রি শহরে গঠিত হয়, ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি’ এবং স্থির হয় পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি। আজিজুল হক ভূঁইয়া মনোনীত হলেন আহ্বায়ক। ওই সভার সভানেত্রী ছিলেন শিক্ষিকা লুলুু বিলকিস বানু।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ সম্পাদক মার্টিন এনালস ও হ্যানস ইয়ান্টসেককে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে রাজি করালেন। আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শে ব্রিটিশ এমপি জন স্টোন হাউজ, ব্রুচ ডগ লাসম্যান ও পিটার শোর সব ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর নিষ্ঠুরতার বিষয় আলোচনার জন্য ১৪ মে তারিখে পার্লামেন্টের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হন। আলোচনার পূর্বদিন ‘নীরব বিবেক’ নামে দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকা এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

উল্লেখ্য, মার্চে ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ বিবৃতকালে বিলেতের অবজারভার পত্রিকায় বাঙালি চরিত্রের বর্ণনা দেয় যে, দুই বাঙালি দুইজনে আলাদা দুই দল গঠন করে আবার দুইজন মিলে তৃতীয় দল তৈরি করে। বাঙালিরা শান্তিপ্রিয় কিন্তু ভিত লোক; তারা এবার ক্ষেপেছে, রুখে দাঁড়াবে, হয়তোবা অচিরে পৃথিবীতে একটি নতুন দেশ হবে।

ব্রিটেনের ছায়া সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনিস হিলি পার্লামেন্টে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য বিশেষ জোর দেন এবং বলেন, ‘শেখ মুজিবই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি’। প্রবাসী সরকারের পরামর্শে ২৪ মে বিচারপতি চৌধুরী গ্লাসগো থেকে নিউ ইয়র্ক গেলেন। শুরু করলেন একে একে অনেক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের সাথে সাক্ষাৎ। যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝালেন তাদের বাংলাদেশের পক্ষে থাকার জন্য, শেখ মুজিব তো তাদের মতাদর্শের ও পুঁজিবাদের প্রবক্তা। উপমহাদেশে শান্তির জন্য শেখ মুজিবের অনতিবিলম্বে মুক্তি অত্যাবশ্যক।
বিচারপতি চৌধুরীর প্রচেষ্টায় জুন মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চারজন নামি সদস্যÑ কনজারভেটিভ দলের জেমস রেমসটেন ও টবি জোসেফ এবং শ্রমিকদলের আর্থার বটমলি ও রেজিনান্ড প্রেনটিস বাংলাদেশ ও ভারত সফর করে যে তথ্য প্রকাশ করেন তাতে বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত হয়।
২৬ জুলাই তারিখে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানচিত্র ও শেখ মুজিবের ছবি যুক্ত দু’টি ডাকটিকিট উন্মোচিত হয়। ১ আগস্ট মাসে ট্রাফালগার স্কয়ারের জনসভায় লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১০ আগস্ট পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য ফাঁসি চেয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করে। চিন্তিত বিচারপতি চৌধুরী বিভিন্ন সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রের সহায়তায় জাতিসঙ্ঘে শেখ মুজিবের বিচার বন্ধের দাবি উপস্থাপন করলেন এবং পুরো সেপ্টেম্বর মাস পরিভ্রমণ করলেন একে একে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। দেখা করলেন সব দেশের প্রধান বিচারপতিদের সাথে, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল শেখ মুজিবের মুক্তির লক্ষ্যে ‘সুইডেনের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। অসলো বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের গণহত্যা সংক্রান্ত কমিশন গঠনে উৎসাহিত হলো।
বাংলাদেশকে সমর্থন ও স্বীকৃতিদানের জন্য খন্দকার মোশতাক আহমদ উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যৌথভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম চিঠি লেখেন ভারতের দৃষ্টি এড়িয়ে যা ২৬ মে ১৯৭১ তারিখে বার্লিন থেকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো হয়।
২৮ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক কলকাতায় মার্কিন দূতাবাসের সাথে বৈঠক করেন। শেখ মুজিবের মুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়ে কম মূল্যবান নয় বিবেচনায়। এ আলোচনায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্মতি ছিল। শোনা যায় আওয়ামী লীগের জহিরুল কাইয়ুমসহ অপর ৪৩ জন জাতীয় সংসদ সদস্য আলোচনা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।

খন্দকার মোশতাক মার্কিন দূতাবাসকে বুঝিয়েছিলেন, শেখ মুজিববিহীন বাংলাদেশ হবে পরোপুরি কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত ভারতের করদ রাজ্য। অক্টোবর মাসে ভারতপ্রবাসী সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন আলোচনার সংবাদ পেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পররাষ্ট্রবিষয়ক পরামর্শদাতা ডিপি ধর কলকাতায় এসে ‘মোশতাককে বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দেন এবং প্রবাসী সরকারকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদলাতে বাধ্য করেন। আবদুস সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রকৌশলী এফ আর খান ও অন্যদের মাধ্যমে মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রের প্রশাসনকে প্রভাবিত করেন শেখ মুজিবের বিচার স্থগিতের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদোহিতার মামলা থেকে রেহাই দিয়ে ফাঁসির দণ্ড থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করে। মার্কিন প্রশাসন বিশ্বাস করে যে, কেবল শেখ মুজিবই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে কমিউনিস্ট ও ভারতের কবল থেকে মুক্ত রাখতে পারবেন।
নভেম্বর মাসে পাকিস্তান হঠাৎ শেখ মুজিবের বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত করে।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পাকিস্তান কনফেডারেশন গঠনের প্রত্যাশায়।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি রাত ৩টায় পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের বিমানে ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনের পথে যাত্রা করেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে বিদায় জানান এবং ফোনে সংবাদটা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে জানিয়ে দেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অনুরোধ অগ্রায্য করে, ভারতীয় বিমানের পরিবর্তে ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের প্লেনে বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন নয়া দিল্লি হয়ে। তারিখটি ছিল সোমবার, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের পদাবনতি ঘটে। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হন। পাকিস্তানকে সহায়তা করার অপরাধে বরখাস্ত আইয়ুব খানের প্রিয়পাত্র এসএমএস সফদর পিএসপি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পূর্বপদে যোগ দেন একই দিনে ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo
error: Content is protected !!