ড. মো. হুমায়ুন কবীর- এখন প্রায়শই শোনা যায় সারাদেশের কোনো না কোনো স্থানে আকষ্মিক বজ্রপাতে লোকজন মারা যাচ্ছে। এগুলো এখন আর কোনো মৌসুম কিংবা ফর্মুলা কিংবা নিয়মনীতি মানছে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো আর কিছুই না, তা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
আগে দেখা যেতো বছরে বজ্রপাত হতে দু-চারজনের মৃত্যুর খবর কালেভদ্রে পাওয়া গেলেও এখন ফি-বছর বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করছে। এবছরেও ইতোমধ্যে সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব রেকর্ড করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাকে সরকারের তরফ থেকে দুর্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কীভাবে এসব আকষ্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত হলো- খালি মাঠে কিংবা রাস্তার পাশে এমনকি বিল-ঝিল, হাওর-বাওড়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, পাহাড়-বন, খাল-বিল, নদ-নদী, সাগর তীর প্রভৃতির পাড়ে কিংবা চারপাশে উন্মুক্ত স্থানে বেষ্টনী তৈরী করে উঁচু উঁচু গাছ লাগাতে হবে। সেসব গাছই থান্ডার এরেস্টার (বজ্রপাত শোষক) হিসেবে কাজ করবে। তাতে গ্রামান্তরে বজ্রপাতের দরূন কৃষক কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ মারা যাওয়া থেকে রেহাই পাবে।
এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের দেশের মাননীয় পরিবেশবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি তার একটি বক্তৃতায় বলেছেন, সারাদেশে প্রতিবছর কমপক্ষে তিন কোটি তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি উঁচু গাছ রোপন করতে হবে যাতে আমাদের দেশের কৃষক মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুবরণ না করেন। কারণ এ দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত উন্মুক্ত স্থানেই বেশি ঘটতে দেখা যায়। তাছাড়া শহরের সচেতন মানুষ তারা তাদের বাড়ি-ঘর বানানোর সময় আগেই পরিকল্পিতভাবে থান্ডার এরেস্টার লাগিয়ে কিছুটা হলেও নিরাপদে থাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা শোনার পর দেশজুড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, সংস্থা তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি গাছ লাগানো শুরু করে দিয়েছেন। এতে সম্পৃক্ত হয়েছে স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। তবে সবচেয়ে অগ্রগামী হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদেরকে সহযোগিতা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মাঠকর্মীসহ প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা। আমি এমন একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করব এখানে। ছড়া কবিতার কথায় আছে, ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’। অর্থাৎ তালগাছ একসময় সবগাছ থেকে উঁচুতে উঠে যায়।
তালগাছ সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। সেটি হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি তালগাছ রোপন করে, সে ব্যক্তি সেই গাছের তাল খেয়ে মরতে পাওে না’। তার মানে হলো তালগাছের বাড়-বাড়তি খুবই ধীর গতিতে ঘটে। কিন্তু কথাটি আসলে মোটেও ঠিক নয়। কারণ আমি নিজে আমার বাড়িতে পনের বছর বয়সে যে তালগাছ নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম এখন আমার ৪৭ বছর বয়সে এসে আরো পাঁচ বছর আগে থেকেই সেই গাছের তাল খেয়ে চলেছি। তার থেকে বড় বাস্তব উদাহরণ আর কি হতে পারে! অর্থাৎ তাল গাছ লাগানোর ২৫-৩০ বছরের মধ্যেই সেটা থেকে ফল খাওয়া যেতে পারে।
তালগাছ এখন আমরা যে শুধু বজ্রপাত হতে রক্ষা করার জন্য লাগাবো তাই নয়। এর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার ও উচ্চ খাদ্যমান। যেমন তালের পাতা দিয়ে ঘরের মাদুর তৈরি করা হয়, তলের পিঠা, তালের রস থেকে নানারকম পিঠা, পায়েস তৈরী করা হয় যা আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। হিন্দুশাস্ত্রের কৃষ্টিতে আছে তাল নবমী, তালের রস ক্যান্সার প্রতিরোধী, তালগাছ দিয়ে তৈরি হয় তালের নৌকা। তালপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, বিভিন্ন কুটির শিল্প, কাÐ দিয়ে বাড়িঘরের প্রয়োজনীয় কাঠ ও নৌকা তৈরি করা হয়। তালের কাÐ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি এবং একপ্রকার চোলাই মদ তৈরী করা হয় যাকে সবাই ‘তারি’ বলে চেনেন।
তাছাড়া তাল এন্টি অক্সিডেন্ট গুণসমৃদ্ধ হওয়ায় ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তালের রসে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। তাল ভিটামিন-বি এবং ভিটামিন-এ এর আধার। তালে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে যা হাড় ও দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্ত্রের রোগ ভালো রাখতেও তালের জুড়ি নেই। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে প্রতি ১০০ গ্রাম তালে ৮৭ কিলোক্যালোরি খাদ্যশক্তি বিদ্যমান। এতে আরো রয়েছে, জলীয় অংশ- ৭৭.৫০ গ্রাম, আমিষ-০.৮ গ্রাম, চর্বি-০.১ গ্রাম, শর্করা ১০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ- ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম-২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস-৩০ মিলিগ্রিাম, আয়রন-১ মিলিগ্রিাম, থায়ামিন-০.০৪ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাবিন-০.০২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন-০.৩ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন নি-৫ মিলিগ্রাম ইত্যাদি।
বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে তালের আঁটি রোপন। এমনি একটি মহতি উদ্যোগের সাথে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত তালগাছ রোপন কার্যক্রমে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। সেদিন তারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দ্বীপক কুমার পালের নেতৃত্বে উপজেলার সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এ তালের আঁটি রোপন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। আমি এ কার্যক্রমে একটু বেশি আগ্রহ বোধ করেছি, কারণ একেতো আমি নিজেও একজন কৃষিবিদ আর সেই তালের আঁটিগুলো লাগানো হচ্ছে আমাদের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সহযোগী ছাড়াও সেখানকার বেশ ক’জন সংবাদ কর্মীও উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই আশাকরি সামনের কয়েক বছরেই তাল, সুপারি ও নারিকেল গাছ দিয়ে ভরে উঠবে সারাদেশের আনাচে-কানাচে, যাতে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দূরীভূত করা সম্ভব হবে।
ড. মো. হুমায়ুন কবীর: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়