জসিম উদ্দিন-এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মাঝে মহাসমুদ্রের কয়েক হাজার কিলোমিটারজুড়ে ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান। এক দিকে প্রশান্ত মহাসাগর অন্য দিকে ভারত মহাসাগর। স্থল সীমান্ত রয়েছে মালয়েশিয়া, বোর্নিও, পাপুয়া নিউগিনি ও ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতা পাওয়া দেশ পূর্ব তিমুরের সাথে। সরু প্রণালী দ্বারা আলাদা হয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের সাথে। ১৭ হাজারের বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বৃহৎ মুসলিম দেশ। জাতিগত ভিন্নতার দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশটিতে সাত শ’র বেশি ভাষা প্রচলিত। সুকর্নের নেতৃত্বে ১৯৪৫ সালে স্বাধীনতার পরপরই দেশটি সুপারপাওয়ারদের রাজনৈতিক খেলার মাঠ হয়ে দাঁড়ায়।
মার্কিনিদের পুঁজবাদ ও সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বে বলির পাঁঠা হন প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্ন। যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর মধ্যে নিজেদের মদদপুষ্ট গোষ্ঠী তৈরি করে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায়। গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র কূটচালে পরাজিত হয় সমাজতন্ত্রীরা। সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড় করানো হয় তাদের। দেশটির বিশাল সেনাবাহিনী মস্কো ও চীনপন্থীদের ওপর চালায় জাতিগত নিধন। সুহার্তের নেতৃত্বে দেশটি চলে যায় পুঁজিবাদের একক আনুকূল্যে। একনাগাড়ে তিন দশক শক্ত হাতে দেশ শাসন করেন সুহার্তো। পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় শুরু হলে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
তত দিনে মার্কিনিদের কাছে তার প্রয়োজনও ফুরিয়ে যায়। দেশটির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে সুকর্ন আর সুহার্তোর নামটি সবার আগে উঠে আসে। একজন স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। অন্যজন একনায়কত্ব কায়েম করে দীর্ঘকাল দেশ শাসন করেছেন। সুহার্তোর কিছু ভালো দিকও ছিল। বিশাল দেশটির শাসন কাঠামোকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। হাজার হাজার দ্বীপের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীকালে অনেকগুলো প্রমাণিতও হয়েছে।
অন্য দিকে আহমদ সুকর্ন দেশটি প্রতিষ্ঠাতা। নানান ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে প্রায় দুই যুগ তিনি দেশটি শাসন করেন। এরই মধ্যে কয়েকবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। তিনি ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম রাজনৈতিক দল, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সমাজতান্ত্রিক দল এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারসাম্য রেখে দেশ পরিচালনা করেন। সবশেষে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সৃষ্ট প্রপাগান্ডা আর গুপ্তচরবৃত্তির কাছে পরাস্ত ও ক্ষমতাচ্যুত হন।
ল্যাটিন ইন্ডাস থেকে ইন্দোনেশিয়া শব্দটি এসেছে। ল্যাটিন শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় দ্বীপ। ডাচ উপনিবেশের কারণে তাদের দেয়া নামটি ওই অঞ্চলের জন্য প্রচলিত হয়। ১৯০০ সাল থেকে জায়গাটি ইন্দোনেশিয়া নামে পরিচিতি পায়। দেশটিতে মানুষ বসতির ইতিহাস বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো। যাদের বলা হয় ‘জাভাম্যান’। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে তাইওয়ান থেকে একটি মানব প্রবাহের ধারা ইন্দোনেশিয়ায় যায় খ্রিষ্টজন্মের দুই হাজার বছর আগে। তারা আদিবাসীদের ধীরে ধীরে আরো পূর্ব দিকে নিয়ে যায়। প্রথম শতাব্দীতে সভ্যতার বিস্তার ঘটে। কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ সমাজ গঠিত হয়। গড়ে ওঠে অসংখ্য শহর-নগর-বন্দর। সমুদ্র উপকূলে বিস্তার ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্য। চীনের সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে ইন্দোনেশিয়া হয়ে। এর ফলে দেশটিতে এক দিক থেকে হিন্দু ধর্ম অন্য দিক থেকে আসে বৌদ্ধ ধর্ম। দু’টি ধর্ম জীবনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিমদের আগমন ঘটে। উত্তর সুমাত্রা হয়ে ক্রমে মুসলমানরা ছড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার মাইলের বিস্তৃত ইন্দোনেশিয়ায়। ষোড়শ শতাব্দীতে দেশটির প্রধান ধর্ম হয়ে যায় ইসলাম। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি ক্রমেই ছাপিয়ে গিয়েছিল বৌদ্ধ আর হিন্দুপ্রধান এ অঞ্চলে। এর পর ধাপে ধাপে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে দেশটিতে। ব্রিটিশ আর ডাচরা তাদের সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও ধর্ম ও সংস্কৃতিতে তারা কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি।
১৬০২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় ব্যবসা শুরু করে। তারা ক্রমেই দেশটিতে প্রধান ইউরোপীয় শক্তিতে পরিণত হয়। নেদারল্যান্ড সরকার এক পর্যায়ে দেশটিতে উপনিবেশ স্থাপনে সক্ষম হয়। বিংশ শতাব্দীতে বর্তমান ইন্দোনেশিয়া নামের সমগ্র ভূখণ্ডটির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে জাপান এটি দখল করে নেয়। তারা বিশ্বযুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার দু’দিন পর ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী নেতা সুকর্ন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নেদারল্যান্ড আবার তাদের উপনিবেশ স্থাপন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
দেশের নাম :
রিপাবলিক অব ইন্দোনেশিয়া
জনসংখ্যা :
২৩ কোটি ৪৩ লাখ
রাজধানী :
জাকার্তা
আয়তন :
১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার
প্রধান ভাষা :
বাহাসা, ইংরেজি ও ডাচ
প্রধান ধর্ম :
ইসলাম
গড় আয়ু :
৬৯ বছর (পুরুষ), ৭৩ বছর (মহিলা)
মুদ্রা :
রুপিয়াহ
প্রধান রফতানি পণ্য :
তেল, গ্যাস, প্লাইউড, টেক্সটাইল, রাবার এবং পামওয়েল
মাথাপিছু আয় :
১ হাজার ৬৫০ ডলার
ইন্দোনেশিয়ায় শাসন পদ্ধতি প্রেসিডেন্ট শাসিত এককেন্দ্রিক। ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের পর শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার করা হয়। মন্ত্রিপরিষদের গঠন ও নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট। মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার জন্য আইনসভার সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। আইন পরিষদের নাম পিপল কনসালটেটিভ অ্যাসেম্বলি। এর প্রধান কাজ সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নীতিনির্ধারণ। প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার ক্ষমতাও রয়েছে এর। আইন পরিষদের দু’টি কক্ষ। একটি হচ্ছে পিপলস রিপ্রেজেনটেটিভ কাউন্সিল। এর সদস্যসংখ্যা ৫৫০। অন্যটি রিজিওনাল রিপ্রেজেনটেটিভ কাউন্সিল। এর সদস্যসংখ্যা ১২৮। ২০০৪ সালে প্রথম জনগণের সরাসরি ভোটে দেশটির প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়।
৩৩টি প্রদেশ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গঠিত। এর মধ্যে পাঁচটির রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। প্রত্যেকটি প্রদেশের রাজ্য গভর্নর এবং আলাদা আইনসভা রয়েছে। প্রদেশগুলোকে শাসন সুবিধার জন্য রিজেন্সি এবং সিটিতে ভাগ করা হয়েছে। নিচের দিকে আরো বেশ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিট করা হয়েছে। সবার নিচে রয়েছে গ্রাম। আচেহ, জাকার্তা, ইউগিয়াকারতা, পাপুয়া এবং পশ্চিম পাপুয়াকে অনেক বেশি মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আচেহ প্রদেশ নিজেদের আইন প্রণয়নের অধিকার দেয়া হয়েছে। তারা শরিয়া বিধান মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালনা করে।
আয়তনের দিক দিয়ে ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের ষোলতম বৃহৎ দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৩৪ জন। জাভা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপর্ণ দ্বীপ। দ্বীপটির প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৪০ জন মানুষ বাস করে। দেশটি ভূমিকম্পপ্রবণ এবং রয়েছে বেশ কিছু জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। দেড় শ’টির মতো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। ২০০৪ সালে সৃষ্ট সুনামিতে ২ লাখ বিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। নিচু এলাকায় গড়ে ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়। পার্বত্য এলাকায় বৃষ্টিপাত ৬ হাজার মিলিমিটারেরও বেশি।
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জীববৈচিত্র্যের দেশ (ব্রাজিলের পর)। এর জীব ও উদ্ভিদ শ্রেণীর মধ্যে এশীয় ও অস্ট্রেলীয় সংমিশ্রণ দেখা যায়। সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও এবং বালিতে এশীয় প্রাণীদের বিচিত্র সমারোহ। এখানে রয়েছে হাতি, বাঘ, চিতা, গণ্ডার ও বৃহদাকার বানর। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ বনভূমি। অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত পাপুয়ায় ৬০০ প্রজাতির পাখির বাস। পাখিদের ২৬ শতাংশ পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। দেশটির সমুদ্র উপকূলের দৈর্ঘ্য ৮০ হাজার কিলোমিটার। দেশটির জীববৈচিত্র্যের প্রধান কারণ এ দীর্ঘ উপকূলরেখা। দ্রুত শিল্পায়নের ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক ধস ইন্দোনেশিয়াকে বিপর্যস্ত করে। এর সূত্র ধরে সুহার্তো সরকারেরও পতন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট সুসিলো বামবাং ইয়োধোয়োনোর নেতৃত্বে দেশটির অর্থনীতি উজ্জীবিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য রয়েছে ব্যাপক হারে। ২০০৮ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন ছিল প্রায় চার হাজার ডলার। অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত শিল্প। জাতীয় উৎপাদনে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে ১৩ দশমিক পাঁচ, ৪৫ দশমিক ছয় ও ৪০ দশমিক আট শতাংশ। জাতীয় আয়ে কৃষির অবদান তৃতীয় হলেও ৪২ শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষিতে নিয়োজিত। দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১১ কোটি বিশ লাখ।
২০০০ সালের জাতীয় জরিপ অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা ২০ কোটি ৬০ লাখ। ২০০৬ সালে পরিচালিত অন্য একটি জরিপে দেখা যায়, দেশটির জনসংখ্যা বেড়ে ২২ কোটি ২০ লাখে দাঁড়িয়েছে। কেবল জাভাতে ১৩ কোটি লোক বাস করে। জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগেরই মূল অস্ট্রেনেশিয়ান যারা মূলত তাইওয়ান থেকে এসেছিল। জনসংখ্যার অন্য বড় অংশটির মূল হচ্ছে মেলানেশিয়া। দেশটির মধ্যে তিন শ’র বেশি জাতি-গোত্র আর সাড়ে সাত শ’র মতো ভাসা। সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কথা বলে জাভানিস ভাষায়। জনসংখ্যায় তারা ৪২ শতাংশ। জাভার মানুষ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও প্রভাবশালী। চীনা ইন্দোনেশীয়রা জনসংখ্যায় মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দেশের বেশির ভাগ সম্পদের মালিক তারা। সরকার ঘোষিত ৬টি ধর্ম হলো ইসলাম, খ্রিষ্টানদের দু’টি গ্রুপ, হিন্দু, বৌদ্ধ ও কনফুসীয়। জনসংখ্যার ৮৬ দশমিক ১ শতাংশ মুসলিম। খ্র্রিষ্টান ধর্মানুসারী ৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৩ শতাংশ। দেশটিতে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে। আরবীয়, ভারতীয়, চীনা, মালয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশেল রয়েছে জীবনাচরণে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ব্যাডমিন্টন ও ফুটবল।
ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর আকার বিশাল। সরকার নির্বাচিত সদস্যদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক। দুই বছর করে সেনাবাহিনীতে কাজ করতে হয়। সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সামর্থ্য রয়েছে প্রায় ১১ লাখ মানুষের। নিয়মিত সেনাসংখ্যা ৩ লাখ ৩ হাজার। নৌবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৭৪ হাজার এবং বিমানবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩৩ হাজার। সংসদে ৩৮টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে প্রতিরক্ষাবাহিনীর সদস্যদের জন্য। জাতীয় উৎপাদনের ৩ শতাংশ ব্যয় হয় সামরিক খাতে।