ফেনী
মঙ্গলবার, ২১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৪:১৩
, ২০শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি
শিরোনাম:
রাজাপুরে হিলফুল নূর ফাউন্ডেশনের শীতবস্ত্র উপহার ফেনীতে বর্নাঢ্য আয়োজনে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত  ফেনী বড় মসজিদের এলইডি স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আ.লীগ আবার ফিরবে,জয়বাংলা উপজেলা-পৌর কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে চরদরবেশ ইউনিয়ন বিএনপির আনন্দ মিছিল নিজ দলীয় ত্যাগী-নির্যাতিত কর্মীর পাশে থাকায় ষড়যন্ত্রের শিকার বিএনপি নেতা আহবায়ক কমিটি দিয়ে ৫ বছর পার ফেনীর বিএনপির ফাজিলপুরে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর মানববন্ধন নানা আয়োজনে ফেনী মুক্ত দিবস পালিত ঢাকাস্থ ফাজিলপুর যুব কল্যাণের জিপিএ ৫ সংবর্ধনা আ.লীগের রাজনীতি করার অধিকার আছে কিনা তা জনগণই ঠিক করবে-ফখরুল

বেসরকারি ব্যাংকেও কালো ছায়া পড়তে শুরু করেছে

 

 

 

সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু-একসময় মনে করা হতো সরকারি ব্যাংকে যেভাবে আর্থিক অনিয়ম বা লুটপাট করা সম্ভব, বেসরকারি ব্যাংকে তা সম্ভব নয়। কারণ সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক ও আমলাতন্ত্রিক প্রভাব কাজ করে। এই প্রভাবের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকে আর্থিক অনিয়ম করা হয়। যারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য নয় তাদেরও ঋণ দেয়া হয়। ঋণ দেয়া হয় বেনামে, ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। যাদের কাছ থেকে কখনো ঋণ ফেরত পাওয়া যায় না। এই সব ঋণ কেলেঙ্কারির প্রকৃষ্ট উদাহরণ, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপ। কিংবা বেসিক ব্যাংক লুটপাট।

হলমার্ক কেলেঙ্কারি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালীতে। আর বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাষ্ট্রীয় খাতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক জনতায়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এই সব ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। যার কানাকড়িও উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক থেকে এভাবে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ। অভিযোগ রয়েছে, এই সব আত্মসাতের সাথে জড়িত ছিল সরকারঘনিষ্ঠ লোকজন ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
সরকারি ব্যাংকে এ ধরনের লুটপাট বছরের পর বছর ধরে চললেও এসব থেকে অনেকটা মুক্ত ছিল দেশের বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। এখানে ছোটখাটো দুর্নীতি ও অনিয়ম হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারিতে বড় ধরনের কোনো অনিময় বা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেনি বলা চলে। কিন্তু সে অবস্থা পাল্টে যেতে শুরু করে গেল কয়েক বছর ধরে। কিন্তু এখন সরকারি ব্যাংকের পর বেসরকারি ব্যাংকেও কালো ছায়া পড়তে শুরু করেছে।

২০১৩ সালে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় সরকার, এই ব্যাংকগুলোর অনুমোদনের পেছনে কাজ করেছে রাজনৈতিক বিবেচনা। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, এসব ব্যাংকের বেশির ভাগেরই পেশাদারি মনোভাব গড়ে ওঠেনি। এর ফলে অনুমোদন পাওয়া তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর প্রায় সবগুলোর অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থায় রয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (এলআরবিসি) ও দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড। প্রথম ব্যাংকটির মালিক সরকারঘনিষ্ঠ বিদেশপ্রবাসী সিলেটের এক ব্যবসায়ী ফরাসত আলী। এবং দ্বিতীয় ব্যাংকটির কর্ণধার হিসেবে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এমপি।

এনআরবিসি ব্যাংক

এনআরবিসি ব্যাংকটি ২০১৩ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংক হিসেবে অনুমোদপ্রাপ্ত হয়ে একই বছর ২ এপ্রিল থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই ব্যাংকটির পরিচালকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, ঋণ প্রদানে অনিয়ম এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ঘাটতি দেখা যায়। এসব কথা আর কেউ বলেনি, বলেছে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদন মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এই ব্যাংকের সাত ধরনের অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি অনিয়ম আবার বড় ধরনের। এই অনিয়মের মধ্যে রয়েছে এনআরবিসি পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে তাদের উপস্থিত দেখিয়ে সভার কার্যবিবরণী প্রস্তুত করা হয়েছে। ঋণ দেয়ার কোনো নিয়ম আচার না মেনে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (আরেকটি বেসরকারি ব্যাংক) চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনূকূলে ঋণ দেয়া হয়েছে। অনিয়মের মধ্যে আরো রয়েছে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ প্রদান এবং ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির সাথে পরিচালনা পর্ষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সম্পৃক্ততা।
অনিয়মের এখানেই শেষ নয়, কোম্পানি আইনের বিধান এবং ব্যাংকের আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশনের সংশ্লষ্ট ধারা লঙ্ঘন করে ব্যাংকের একজন পরিচালকের অনুপস্থিতিতে তার শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে পর্ষদ কর্তৃক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ব্যাংকিং নিয়মকানুন অনুসরণ না করেই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় ছয়জন পরিচালকের শেয়ার বায়েজাপ্ত করা হয় এবং তিনজন পরিচালককে অপসারণ করা হয়। ব্যাংকটি গঠনের সময়ে মূলধন আনয়নে অনিয়ম, অনিবাসীদের পরিবর্তে বেনামে বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্যক্তি কর্তৃক ব্যাংকের শেয়ারও ক্রয় করা হয়েছে। যেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এসব অনিয়ম এবং বিভিন্ন অভিযোগের সূত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালিত পরিদর্শনে অনিয়মের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ, করপোরেট দুর্বলতারোধ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও অভ্যান্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উন্নতি, ঋণশৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ, নিবিড় তত্ত্বাবধান মনিটরিংয়ের লক্ষ্যে ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এর পরও ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ও অনিয়ম দূর করা সম্ভব হয়নি। এর কারণও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও হস্তক্ষেপ। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ যেখানে ছিল ১৭২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা; বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ৬৯ লাখ টাকায়। এটি ব্যাংকের মোট ঋণের ৫ শতাংশ। জুন ২০১৭ প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের তুলনায় শ্রেণিকৃত ঋণের হার অনেক বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকটিকে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে বিপুল প্রভিশন (নিরাপত্তাসঞ্চিতি যা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়) রাখতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকটির নিট মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ডিসেম্বর ২০১৬ প্রান্তিকে নিট মুনাফা অর্জিত হয়েছিল যেখানে ৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা, সেখানে জুন ২০১৭ প্রান্তিকে অর্ধবার্ষিক নিট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকায়। এতে বোঝা যায় এই ব্যাংকের বর্তমানে কী ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ফারমার্স ব্যাংক

নাম দেখে মনে হতে পারে এটি কৃষকদের কল্যাণের জন্য স্থাপন করা একটি ব্যাংক। কিন্তু আদৌ তা নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এই ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৩ সালের ৩ জুন ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করা ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা বেশ নাজুক। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তাই বলতে বাধ্য হয়েছে, ‘ব্যাংকটি সমগ্র ব্যাংকিং খাতে সিস্টেমেটিক রিস্ক (পদ্ধতিগত ঝুঁকি) সৃষ্টি করছে, যা আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে। ’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংকে ১৩টি অনিয়ম খুঁজে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল বড় ধরনের অনিয়ম। অনিয়মের মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ নীতিমালা অনুসরণ না করে গ্রাহকদের ঋণসুবিধা প্রদান করা হয়েছে। ব্যাংক কর্তৃক ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত না করে গ্রাহকদের উদ্দেশ্যবহির্ভূত খাতে অর্থ স্থানান্তরে পরোক্ষভাবে সহায়তা করা হয়েছে। গুরুতর অভিযোগের মধ্যে রয়েছে অস্তিত্বহীন/সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলেও ঋণ দেয়া হয়েছে। ঋণ নিয়মাচার লঙ্ঘন করে ব্যাংকে পরিচালকসহ অন্য ব্যাংকের পরিচালকদেরও ঋণ দেয়া হয়েছে। এখানে শেষ নয়, অপর্যাপ্ত ও ত্রুটিযুক্ত জামানতের বিপরীতে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে।
গ্রাহক ঋণ খেলাপি, তবুও তাকে ঋণ দেয়ার ঘটনা উদঘাটন করা হয়েছে ফারমার্স ব্যাংকে। একক ঋণগ্রহিতার সর্Ÿোচ্চ ঋণসীমার অতিরিক্ত ঋণসুবিধাও দেয়া হয়েছে। নিজের ব্যাংকের অবস্থা ভালো নয়, তা সত্ত্বেও অন্য ব্যাংকের ঋণ অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নির্বাহী কমিটি, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং শাখাপ্রধান কর্তৃক এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে গ্রাহকদের ঋণসুবিধা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল ফারমার্স ব্যাংক কাউকে বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারবে না। কিন্তু সেই নির্দেশও মানা হয়নি। দেয়া হয়েছে বড় অঙ্কের ঋণ। প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদের অতিরিক্ত মেয়াদও অনুমোদন করা হয়েছে ঋণ গ্রহিতাদের। এখানে শেষ নয়, লোকবল নিয়োগেও অনিময় করেছে ফারমার্স ব্যাংক।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এই ব্যাংক সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘ক্রমবর্ধমান অনিয়ম প্রতিরোধ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উন্নতি এবং ঋণ নিয়মাচার শৃঙ্খলা আনয়ন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ায় আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারিতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়। তবুও পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি হচ্ছে না।’ আরো বলা হয়, ‘এক বছর ধরে ব্যাংকটির তারল্য সঙ্কট রয়েছে এবং বর্তমানে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকের মূল তারল্য পরিমাপক সূচক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে। চলতি ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যাংকটি সিআরআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকটি দায় পরিশোধের সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে।

সাধারণ আমানতকারী এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রচলিত হারের চেয়েও উচ্চ সুদে আমানত গ্রহণ ও অর্থ কর্জ করে বর্তমানে ব্যাংকটি টিকে আছে। ব্যাংকের ৫৪ শাখার মধ্যে ২৮টি শাখা লোকসানে রয়েছে। ’
এখানেই শেষ নয়, বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ও এসআইবিএল পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের সহায়তায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর এই পরিবর্তনের ফলে এই ব্যাংকের অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিস্তৃত হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকের ওপর দীর্ঘস্থায়ী কালো ছায়া।

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo