মইনুল হোসেন– রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে আমাদের সরকার নানাভাবে ভুল করে চলেছে। ক্ষমতায় থাকার আমলাতান্ত্রিক কলাকৌশল সরকারকে রাজনৈতিকভাবে অসহায় করছে, আর জাতির জন্য বেড়ে চলেছে নিরাপত্তাহীনতার ভয়ভীতি। সরকারের সে দিকে লক্ষ করার দেয়ার সময় আছে বলেও মনে হচ্ছে না।
রোহিঙ্গাদের মানবিক সঙ্কট নিয়েও সরকার ভয়ভীতি সৃষ্টির সুযোগ খুঁজছিল। তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতে পারে এমন ধারণাও দেয়া হচ্ছিল। সর্বস্বান্ত অবস্থায় শুধু জীবনে বেঁচে থাকার জন্য অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করে যারা অন্যত্র যাওয়ার উপায় না পেয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে তাদের আশ্রয় দেয়া হবে কি না তা নিয়েও দ্বিধা চলছিল, এখনো আছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে আসার পেছনে সরকারবিরোধীদের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে এমন সন্দেহও করা হয়েছে। মোটকথা, একটি ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেও আমাদের সরকারের নিজেদের জন্য কোনো বিপদ আসবে কি না তাই ভাবতে হয়েছে। ভারত তো এখনো মিয়ানমারের সন্ত্রাসী তৎপরতার কথা বলছে।
ভারতের নীতি এবং তার সমর্থন পাওয়া যাবে কি না সেটিই ছিল আসল প্রশ্ন। এখন ভারতের সমর্থন চাওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে।
আমাদের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এটা মানতে হবে যে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অনেক সত্য সবার জানা নেই। বাংলাদেশের দায়িত্ব হলো রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বমত সৃষ্টির জন্য সঠিক চিত্র তুলে ধরা। মিয়ানমার তো প্রচারণা করে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা বহিরাগত মুসলমান এবং তারা সন্ত্রাসী। অথচ রোহিঙ্গারা কয়েক শত বছর ধরে সেখানে আছে। জাতিসঙ্ঘ ২০১৩ সালে রোহিঙ্গাদের সর্বাধিক নির্যাতিত শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের নাগরিকত্ব হতে বঞ্চিত করা হয়েছে অনেক আগেই। সরকার সক্রিয় হতে পারলে প্রথম থেকেই যথেষ্ট আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা পেতে পারত। আমাদের জানামতে তুর্কি প্রচুর খাদ্যসামগ্রী সাহায্য হিসেবে পাঠিয়েছে।
মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণহত্যা বিশ্ববিবেককে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। আশ্রয়প্রার্থীদের জীবন কিছুটা সহজ করার জন্য আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিলম্ব করেছি। এখনো বিশ্বজনমতের কাছে সমস্যা তুলে ধরতে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা তেমন দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, কিছু হারাতে হয় কি না। সে ভয়েই সরকার উদ্বিগ্ন। অন্যরাও সাহস নিয়ে এগোতে ভয় পাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত রয়েছেন। কার বিরুদ্ধে কী ধরনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আসবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে সবাইকে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢেউ বাংলাদেশে আছড়ে পড়ার পর বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেকটা বিচ্ছিন্ন এর প্রমাণ পাওয়া গেল। যে তিনটি দেশকে বাংলাদেশের অত্যন্ত আপন বন্ধু ভাবা হয় তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রকাশ্যে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়েছে। জন্মলগ্ন থেকেই যেসব পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে বাংলাদেশের শত্রু ভাবা হয়ে আসছে তাদের পক্ষ থেকেই সর্বাগ্রে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে এবং সমর্থন ও সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে।
আমাদের দেশে আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধি-পরামর্শমতো ভয়ভীতির অসহনশীলতা চলছে। আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী বিজয়কে সে দেশের আদালত এক রায়ে বাতিল ঘোষণা করলে সে রায় মেনে নিতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি। এই একটি উদাহরণ আমাদের সরকারের লজ্জিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট, কারণ শাসনতন্ত্রের একটি সংশোধনীকে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক ঘোষণা করলে সরকার সে ঘোষণার প্রতি সম্মান না দেখিয়ে আজেবাজে বক্তৃতাবাজি করতে থাকে।
কেনিয়ার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘ঘোষিত রায়ের বক্তব্যের সাথে আমি একমত নই; কিন্তু আদালতের রায় আমি মেনে নিয়েছি’। মজার ব্যাপার হলো, জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকেরা পর্যন্ত নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করেছিল।
সবার জানা আছে যে, একনায়কদের মধ্যে একজন ভয়ঙ্কর একনায়ক ফিলিপাইন শাসন করছে, যিনি ড্রাগ সমস্যার নাম করে শত শত লোককে হত্যা করেছে। তারপরও সেখানকার নির্বাচিত সিনেট সেই একনায়কের ছেলে ও জামাতাকে ড্রাগসংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে সিনেটের সামনে হাজির করতে কোনো ভয় পায়নি।
আমাদের দেশের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখার জন্য উচ্চ আদালত একটি রায় দিয়ে বিপাকে পড়েছে। অথচ এ রায়ে কেউ তার পদ হারায়নি, কোনো নির্বাচনও বাতিল ঘোষিত হয়নি। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে বিচারপতিদের বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি জনাব এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্করভাবে রেগে গেলেন এবং সব ধরনের অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করা হলো।
এবার ব্রাজিলের দিকে চোখ ফেরানো যাক। সেখানে আমরা দেখতে পাই ব্রাজিলের অবসর গ্রহণকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ক্ষমতাসীন ও সাবেক দু’জন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে কোনো ভয় পেলেন না, দেশ চালানোর নামে অপরাধবাণিজ্য চালানোর অভিযোগ আনলেন তাদের বিরুদ্ধে।
আমার বন্ধু প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল (অব:) ইবরাহিম বীর প্রতীকের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেললাম, যখন তিনি তার দলের সাধারণ সম্পাদকের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটি জনগণের সামনে ব্যক্তিগতভাবে তুলে ধরতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। গুম হওয়াটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা। ফ্রিডম ফাইটার বলতে আমি বুঝি স্বাধীনতার নির্ভীক সেনানি, যে কারো জন্য বা সবার জন্য সে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি খুবই ধূসর। এতটা নেতৃত্বশূন্য নৈরাজ্যিক অব্যবস্থার মধ্যে কেবল তারাই আনন্দে দিন কাটাতে পারে যাদের মধ্যে নেই কোনো দেশপ্রেম, চিন্তাভাবনা বা বিবেক-বিবেচনা। বিশৃঙ্খলা আর অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে সর্বত্র এবং জনগণকে পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। বিদেশীরা যারা আমাদের দেশে কম আগ্রহ নিয়ে আসেন তারা ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ তোলার ট্রলি পর্যন্ত যথাস্থানে পান না।
এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘকাল ধরে আশা করে এসেছে এবং স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য অপরিসীম দুঃখ-যন্ত্রণাও ভোগ করেছে কিন্তু আজ তাদের মনে ভয়ের ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। কারণ, পুলিশের হাতে অত্যধিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার অপব্যবহার করা হচ্ছে। এর জন্য রাজনৈতিক কারণও আছে।
সব কিছুর জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কিংবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এককভাবে দায়ী করা ঠিক হবে না। একদা তারা যেখানে ছিলেন এখন তারা সেখানে নেই। সাবেক অবস্থানে ফিরে যেতেও তারা আগ্রহী নয়। ক্ষমতার আসক্তি সহজেই বৃদ্ধি পায়।
আমেরিকার অন্যতম স্থপতি জর্জ ওয়াশিংটন আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল কারো বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়। এতে ক্ষমতার নেশা পেয়ে বসে। এ জন্যই বলা হয়, যার মাথায় দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো চিন্তাভাবনা নেই সে রাজনীতিবিদ নয়।
জ্ঞাতভীতির ব্যাধি থেকে যারা নিজেদের মুক্ত করার ব্যাপারে সাহস দেখাতে অপারগ স্বাধীনতা তো তাদের জন্য নয়।
জনজীবন থেকে আজ সম্মানবোধ, শালীনতাবোধ বিদায় নিয়েছে যার অনিবার্য প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া অনুভূত হচ্ছে সমাজজীবনে এবং এ বিষয়টি আমরা সবাই অনুভব করছি ও বেদনাবিদ্ধ হচ্ছি।
জনজীবনে যারা পদচারণা করছেন তাদের যেহেতু কোনো জবাবদিহিতা নেই তাই তারা জনগণকে সভ্য জাতির মতো সমীহ করার দায়দায়িত্ব অনুভব করেন না।
বঙ্গবন্ধু তার একাধিক জনসভায় জনজীবনের সাথে সম্পৃক্তদের জনগণকে সম্মান করার কথা বলেছেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জনগণই তাদের প্রভু এবং বিনয়ের সাথে যেন তাদের সেবা করা হয়। মন্ত্রী কিংবা এমপিদের বাদ দিয়ে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের এই উপদেশ দেননি।
আজ মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, মওলানা ভাসানীর নাম ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে অবসরপ্রাপ্ত ও পরিত্যাজ্য টেকনোক্র্যাটদের জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে দেশ চলে এবং রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
রাজনীতি করার যোগ্যতা যার আছে, তিনি জানেন ক্ষমতার রাজনীতি ক্ষমতার জন্য পাশবিক লড়াইয়ের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। দেশের রাজনীতি হয় সুন্দর ও সহনশীল পথে অগ্রসর হবে নতুবা ভিন্নতর বিকল্প হিসেবে অসহনশীল হিংসার রাজনীতি জন্ম নেবে। আর পুলিশবাহিনী ব্যস্ত থাকবে সহিংস রাজনৈতিক শক্তি মোকাবেলার কাজে। বলা হবে, সন্ত্রাস দমন চলছে, কিন্তু কোনো সুফল মিলবে না।
এটা সবাই বোঝেন যে, বোমা তৈরি করা, অস্ত্র মজুদ করা শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির লক্ষণ নয়। হত্যা, ধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায় করার জন্য অপহরণের মতো মারাত্মক অপরাধ ঘন ঘন সংঘটিত হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজের দেশে যিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হচ্ছেন না তিনি আসলেই ভাগ্যবান। জনগণ অসহায়, তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। আগে যেমন ছিল কিংবা যেমনটি আশা করা হয়েছিল পুলিশ তেমন নেই। রাজনীতিকীকরণের কারণে অনেকেই নিজেদের রাজনীতিক বলে ভাবছেন। আমাদের পুলিশের যোগ্যতা আছে; কিন্তু বিভ্রান্তিকর রাজনীতির হাত থেকে তারা নিজেদের রক্ষা করে চলতে জানে না।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দীর্ঘ দিন ধরে ভয়ভীতি ও আতঙ্কের দুঃশাসন চালাতে গিয়ে মিয়ানমারে জঙ্গিতৎপরতার উদ্ভব ঘটেছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা সুযোগ খুঁজছে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য। মিয়ানমারের অস্ত্রশক্তির শাসনব্যবস্থা সেখানে যে আর এক ধ্বংসাত্মক সিরিয়া হবে না, তা সেখানকার নেতৃবৃন্দকেই ভেবে দেখতে হবে।