কাজী আলিম-উজ-জামান-একটি তালিকায় ৩৭ জন এমপি ও দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নাম। এমপিরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের। এ রকম তালিকায় তাদের নাম থাকতে পারে, স্বপ্নেও ভাবেননি তারা। তালিকায় যেহেতু নাম চলে এসেছে, দলের মধ্যে তাদের নিয়ে সন্দেহ-কানাঘুষা। ইনি, এরা? এ-ও সম্ভব? চারদিক থেকে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের জবাব কীভাবে, কতজনকে দেবেন তারা? চাপ নিতে না পেরে একজনের হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হয়ে যায়।
সব ঘটনার মূলে একটি চিঠি। প্রকাশিত খবরে অভিযোগমতে, সপ্তাহ দুই আগে পাকিস্তানের একটি বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের (ইনটেলিজেন্স ব্যুরো বা ইবি) মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয় কয়েকটি গণমাধ্যমের ঠিকানায়। ৩৭ জন এমপি ও দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে অভিযোগ আনা হয়, এরা সবাই নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। অবৈধ ও কলঙ্কিত কাজকর্মের সঙ্গেও এরা আছেন।
চিঠিটি পাওয়ার পর গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের কাজ কী? সঙ্গে সঙ্গে খবরটি প্রচার করে দেওয়া, নাকি আগে যাচাই করে দেখা যে চিঠিটি সঠিক কি না? স্মারক নম্বর, ফন্টের আকার, ভাষার ধরন সংগতিপূর্ণ কি না?
কিন্তু সে দেশের জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘এআরওয়াই’ এসবের কিছুই করেনি। উপস্থাপক খবরটি পাওয়ামাত্রই গদগদ হয়ে ‘স্কুপ’ হিসেবে প্রচার করে দেন। প্রকাশ পেয়ে যায় তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের নামও। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই গোয়েন্দা সংস্থাটির কারও সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি সংশ্লিষ্ট সংবাদদাতা। এমনকি অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের বক্তব্য জানতে একটি টেলিফোনও করেননি।
এআরওয়াইতে খবরটি প্রকাশের পর এই এমপিরা ধরে নেন, সরকার তাদের শায়েস্তা করার জন্যই হয়তো এই গোয়েন্দা সংস্থাটিকে ব্যবহার করেছে। বলা দরকার, পাকিস্তানে এআরআই চ্যানেলের উদ্দেশ্য এবং অর্থায়নের বিষয়টিও বিতর্কিত।
এদিকে খবরটি চাউর হওয়ার পর ওই গোয়েন্দা সংস্থাটির মহাপরিচালক আফতাব সুলতানও ভেবে পান না কোন দিক থেকে কী হয়ে গেল। এ রকম কোনো চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে তারও জানা নেই। তাহলে? এরই মধ্যে এক ডাকসাইটে মন্ত্রী, যার নাম তালিকায় আছে, একদিন সামনাসামনি পেয়ে গেলেন আফতাব সুলতানকে। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আপনি আমাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সহযোগী ঠাওরালেন?’ আফতাব সুলতান ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত আর পেশাগতভাবে ন্যায়পরায়ণ অফিসার। আফতাব জিব কেটে, হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে জানালেন, ‘এ রকম কোনো চিঠি আমরা দিইনি। এটা সম্পূর্ণ উড়ো চিঠি। কেন, কারা কী উদ্দেশ্যে এসব করেছে, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
কোনো উপায় না দেখে, শেষ পর্যন্ত কোনো দিন যা করেনি এই গোয়েন্দা সংস্থাটি, সচরাচর যা তাদের অনুশীলনের মধ্যে নেই, তা-ই করতে বাধ্য হয়। সংস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে জানাতে বাধ্য হয়, আগের চিঠির সঙ্গে তাদের কোনো যোগসূত্র নেই।
তবে এতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। এবার এই গোয়েন্দা সংস্থাটিকে সবাই পেয়ে বসে। সমালোচনার কাঁটায় বিদ্ধ হন আফতাব সুলতান, যিনি সক্ষমতা ও সামর্থ্যের দিক থেকে এই গোয়েন্দা সংস্থাটিকে দেশটির প্রভাবশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কাতারে নিয়ে যেতে সমর্থ হন। সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ ইমরান খান তড়াক করে আফতাব সুলতানের পদত্যাগ চেয়ে বসেন।
এ অবস্থায় প্রত্যাশা ছিল, এআরওয়াই অনুতপ্ত হবে এবং তাদের আগের খবর প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু এই টিভি স্টেশনটি উল্টো পথে হাঁটে। তারা জোর গলায় বলতে থাকে, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া চিঠিটি সর্বাংশে সঠিক এবং তারা তাদের অবস্থান থেকে সরছে না। টিভি সাংবাদিকদের একটি অংশের সমর্থনও পেয়ে যায় এআরওয়াই। এ অবস্থায় গোয়েন্দা সংস্থাটি বাধ্য হয়ে দেশটির ইলেকট্রনিক মিডিয়া নজরদারি প্রতিষ্ঠান ‘পেমরা’য় অভিযোগ করে। অভিযোগ না করে উপায় ছিল না, কারণ গোয়েন্দা সংস্থার টপ ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল এবং মামলায় পুরো বিষয়টি আইএসআইকে দিয়ে তদন্তের দাবি জানান মামলার অতি উৎসাহী বাদী।
এ অবস্থায় এআরওয়াইয়ের দরকার ছিল, পেমরা কাউন্সিল অব কমপ্লেইনটসের কাছে তাদের রিপোর্টের সপক্ষে প্রমাণ দাখিল করা। কিন্তু তারা তা করলেন না। তারা ইসলামাবাদ ও সিন্ধু হাইকোর্টে একযোগে মামলা করে বসলেন পেমরার শুনানি স্থগিত চেয়ে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এ মামলার শুনানির ওপর স্থগিত দিয়ে বসে আছেন। অর্থাৎ হাইকোর্ট না চাইলে পেমরা এ মামলার আর শুনানি করতে পারবে না। তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা যায়, এই মুহূর্তে পেমরায় থাকা ছয় শ মামলা হাইকোর্টে স্থগিত আছে অথবা ঝুলে আছে। আর সুপ্রিম কোর্টে আছে ২৯টির মতো মামলা। এমনকি পেমরার দেওয়া সামান্য কারণ দর্শানোর নোটিশের ওপরও হাইকোর্ট স্থগিত দিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় এআরওয়াই বনাম গোয়েন্দা সংস্থা মামলার কার্যক্রম যে এখন শুরু হচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য।
খবরে জানা গেল, এরই মধ্যে এই বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাটি আরেকটি আইনগত পথে হাঁটা উপযুক্ত মনে করেছে। এই ভুয়া চিঠিটি কে বা কারা মিডিয়ায় ছড়াল, সেটার তদন্ত চেয়ে এফআইআর দাখিল করেছে তারা। এতে আবার সাংবাদিক সমাজ রুষ্ট হয়েছেন। অনেকে এটাকে সাংবাদিকদের হয়রানি করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ কেউ দেখছেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ হিসেবে। আবার গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি যেকোনো মূল্যে সাংবাদিককে আদালতে হাজির করাবেন বলে হুমকি দিয়ে রেখেছেন। এতে বিষয়টি আরও প্যাঁচ খেয়ে গেছে। পুরো ঘটনায় রাওয়ালপিন্ডি/ইসলামাবাদ সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠন করেছে একটি তথ্য অনুসন্ধান কমিটি। তাদের কথা, কোনো একটি দিকে অবস্থান নেওয়ার আগে বাস্তবতাটা জানা বেশি জরুরি।
সব মিলিয়ে অবস্থা ভজকট। সাংবাদিকদের আসলে করণীয় কী? সাংবাদিকদের অবশ্যই সত্যের সঙ্গে থাকতে হবে। সত্য কোনো পণ্য নয় যে তার অনেক ক্রেতা আছে। তবু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি হুমকির বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভালো বিমা হলো, সত্য বজায় রাখা। তারপরও বলতে হয়, সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকেন্দ্রিক ব্যবসায় ভুল-ভ্রান্তি থাকেই। কমবেশি আমরা সবাই ভুল করি। ক্ষতিটা হয়ে যায় তখন, যখন আমরা ভুলটা স্বীকার করি না। আর স্বীকার না করলে আমরা কিছু শিখিও না।
ধরুন, এ ঘটনায় এআরওয়াইয়ের উপস্থাপক যদি তার ভুলের কথা স্বীকার করতেন, তিনি যদি বলতেন যে এটা প্রচার করার আগে তার আরও যাচাই করে নেওয়া উচিত ছিল, তাহলে কিন্তু তিনি প্রশংসাই পেতেন। কেউ তার পদত্যাগ চাইতেন না। এ ঘটনার ভিকটিমরাও বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন।
এ ঘটনাটি থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। প্রথম কথা হচ্ছে জবাবদিহির অভাব। এর অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের ভিত্তি। গণতন্ত্রকে টেকসই ভিত্তি দিতে গণমাধ্যমের যে দায়িত্ব, সেখানে অপসাংবাদিকতা বা উড়ো খবরের যত্নআত্তির কোনো স্থান নেই।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক