ফেনী
বুধবার, ৬ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বিকাল ৫:৫৫
, ৩রা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মুসলিমদের কে বন্ধু কে শত্রু…??

নাজিম সরকার– ২০১৮ সাল শুরু হল আরব আমিরাতে কাতারি প্রিন্সকে আটক রাখার অভিযোগ দিয়ে। নতুন বছরে আরব বিশ্বের রাজনীতি আরো জটিল হবে, সেই ইঙ্গিত বহন করে প্রিন্সকে আটকের খবর। অপরদিকে নীল নদে ড্যাম তৈরী এবং লোহিত সাগরের দ্বীপ নিয়ে ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, মিশর এবং সুদানে যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আবারো টালমাটাল মধ্যপ্রাচ্য। বিভক্ত মুসলিম বিশ্বে বাড়ছে লাশের মিছিল। কারন ইরান ও সৌদি আরব ব্যস্ত প্রভাব বিস্তারে। তুরষ্ক হারানো অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরে পেতে ব্যস্ত। আসুন জেনে নেই কে কোন পথে….?

ইরান, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী এবং সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন দেশ। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার সকল সামর্থ্য থাকার পরেও, শিয়া মতালম্বনের কারনে সুন্নি বিশ্বের কাছে ইরানের গ্রহনযোগ্যতা কম। ১৯৭৯ সালে সমাজতান্ত্রিক স্টাইলে ইরান ইসলামী বিপ্লব ঘটায়। ইরানের বিপ্লব মুসলিম বিশ্বে আশা জাগালেও, ইরান বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রদানে ব্যর্থ। ইরান সবসময় শিয়াদের স্বার্থেই কাজ করে। আমেরিকা ও তার মিত্রদের অর্থনৈতিক অবরোধ দেশটির প্রধান অন্তরায়। তারপরও ইরান মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় শক্তি এবং সৌদি আরব ও ইসরাঈলের সবচেয়ে বড় শত্রু। লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া এবং ইরাকের সরকারের উপর আছে ইরানের একক আধিপত্য। সুন্নিপ্রধান কাতার এবং ফিলিস্তিনের হামাসের সাথে আছে ইরানের গভীর সম্পর্ক। আমেরিকার ইরাক আগ্রাসনের পর সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের দাপট শতগুন বেড়ে গেছে। কিন্তু ১৭০কোটি মুসলমানের নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্ঠা ইরান কখনোই করে নি। তাই মুসলিম জাতির অকৃত্রিম বন্ধু বলা যায় না ইরানকে। ইরানের বন্ধুত্বে স্বার্থ এবং ভূ-রাজনীতিই বেশি থাকে।

সৌদি আরব, মুসলিম বিশ্বের পবিত্র দুইটি স্থানের অভিভাবক হিসেবে মুসলিম বিশ্বের বন্ধু হবার দাবীদার। কিন্তু দশকের পর দশক সৌদি রাজবংশ নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই ব্যস্ত। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দুরে থাক, বরং মুসলিম বিশ্বে বিভক্তি এবং যুদ্ধ সৃষ্টির জন্য সৌদি আরবই অনেকাংশে দায়ী। লেবানন, সিরিয়া, মিশর, ইয়েমেন, লিবিয়া, কাতার এবং ইরাকে অস্তিরতার দায় সৌদি আরব এড়াতে পারে না। ২০১৩ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট মুরসিকে অপসারনে ইসরাঈলের সাথে একযোগে কাজ করার অভিযোগ আছে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে। মুরসিকে সরাতে কোটি কোটি ডলার অর্থ ব্যয় করার পিছনে কারন হচ্ছে, সৌদি রাজবংশ মনে করে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড শক্তিশালী হলে সৌদি রাজবংশের দিন ফুরিয়ে আসবে। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে সৌদি আরবে আরব বসন্ত ঘটলে সৌদ রাজবংশ বিদায় নিবে। তাই কয়েকহাজার মুরসি সমর্থক হত্যাকে সৌদি আরব নীরব সমর্থন দিবে, ইহাই স্বাভাবিক। সিরিয়ার যুদ্ধে বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে সৌদি আরব। ৭বছর ধরে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়া। লিবিয়ার একটি পক্ষকে অর্থ ও অস্ত্র দিচ্ছে সৌদি আরব। গাদ্দাফির সাজানো ফুলের বাগানের ন্যয় লিবিয়া এখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। ইয়েমেনে নিজের পছন্দের সরকারকে বসাতে বিমান হামলা চালিয়ে নিরিহ নারী ও শিশুকে হত্যা করে চলেছে সৌদি সামরিক জোট। লেবাননে যুদ্ধ বাধাতে সাদ আল হারিরিকে আটক রেখেছিল সৌদি আরব। কাতারে সামরিক অভিযান এবং সরকার পতনে ব্যর্থ হয়ে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা। ফিলিস্তিনে ইসরাঈলের দখলদারিত্বকে গোপন সমর্থন দিচ্ছে তারা। আইএস এবং তালেবানের মত জঙ্গীগোষ্ঠীর আদর্শিক গুরু সৌদি আরব। ইরানের কাল্পনিক হামলার ভয়ে এবং রাজবংশ টিকিয়ে রাখতে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের চড়া দামের অস্ত্র দিয়ে নিজেদের পুতুল সেনাবাহিনী সাজিয়েই চলেছে সৌদি আরব। অথচ প্রতিটি রনাঙ্গনে সৌদি আরব ইরানের কাছে ধরাশায়ী। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় শত্রু এখন সৌদি আরব। লিবিয়া, মিশর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেনের রক্তপাত প্রমান করে সৌদি রাজবংশ মানবতার শত্রু।

পাকিস্থান ও ইন্দোনেশিয়া, বিশ্বের মোট মুসলিম জনসংখ্যার ২৫% এই দুই দেশে বাস করে। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারনে পাকিস্থান মুসলিম বিশ্ব বিষয়ে নীরব। অথচ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর সাফল্য এবং ভারতের সাথে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর বীরত্ব কারো অজানা নয়। মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমানবিক বোমার মালিক পাকিস্থানের রয়েছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং চৌকষ সেনাবাহিনী। কিন্তু যুগের পর যুগ অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসন এবং দারিদ্র্যতার ন্যয় অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্থান মুসলিম বিশ্বের সামরিক নেতৃত্ব থেকেও দিন দিন দুরে সরে যাচ্ছে। অপরদিকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ইন্দোনেশিয়া সর্ববৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। ভৌগলিক অবস্থানের কারনে ইন্দোনেশিয়া মুসলিম বিশ্ব থেকে অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু জনগনের চাপে আসিয়ান অঞ্চলের মুসলিমদের স্বার্থে কাজ করতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। যদিও একবিংশ শতাব্দীতে ভৌগলিক অবস্থান কোন বাধা নয় এবংকি ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিও শক্তিশালী ও দ্রুত বর্ধিতমান। কিন্তু বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা এবং ইচ্ছা কোনটিই নেই তাদের।

তুরষ্ক; মিয়ানমার, কাতার, সিরিয়া কিংবা পাকিস্থান যেখানেই মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছে সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তায়েফ এরদোগান। ২০০৩ সাল থেকে তুরষ্কের ক্ষমতায় এরদোগানের একে পার্টি। ২০১৬সালের এক ব্যর্থ অভুত্থান এরদোগানের হাতকে শক্তিশালী করেছে। তুরষ্ক নয় বরং ব্যক্তি এরদোগানই এখন পরিচিত বেশি। ৭০০বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং ইউরোপ জুড়ে অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। বাকি মুসলিম বিশ্বেও অটোমান সুলতানদের খলিফা উপাধির কারনে অটোমানদের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা ছিল। সেই হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে কাজ করছেন তায়েফ এরদোগান। সাম্প্রদিক সময়ে রোহিঙ্গা ও সিরিয়ার শরনার্থীদের পাশে দড়িয়েছে তুরষ্ক। কাতারে ৫০০০সৈন্য নিয়োগ এবং পন্য সরবরাহ করে সৌদি অবরোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে দিয়েছে তুরষ্ক । সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা আনতে ইরান ও রাশিয়ার সাথে কাজ করছে তুরষ্ক। সুদানের Island of Suakin লীজ নিয়ে আফ্রিকার দ্বার উন্মক্ত করেছে, যদিও দ্বীপ নিয়ে সৌদি আরব এবং মিশরের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন শুরু হয়েছে। গতবছর সোমালিয়ায় সামরিক একাডেমী স্থাপন করেছে তুর্কি সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের সাথে শিক্ষা ও সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। ৮২৬ কিঃমিঃ দীর্ঘ রেললাইন স্থাপন করেছে আজারবাইজান হয়ে জর্জিয়া পর্যন্ত। ফিলিস্তিন ইস্যুসহ মুসলিমদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল ইস্যুতে সরব তুরষ্ক। সারাবিশ্ব ব্যাপী নিজেদের আধিপত্য ও নেতৃত্ব প্রসারে ব্যস্ত তুরষ্ক। যদিও সাম্প্রতিক টানাপোড়ন প্রমান করে দিয়েছে, তুরষ্কের ক্ষমতার পরিবর্তনে আমেরিকা ও ইউরোপ বসে নেই। তবু তুরষ্ক থেমে নেই, একাই লড়ে যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের জন্য। যুগের পর যুগ ধরা চলা সামরিক শাসন কাটিয়ে রাশিয়া এবং ইরানের মত বন্ধু নিয়ে তুর্কি নেতা এরদোগান হারানো অটোমান সাম্রাজ্যের সেই নেতৃত্ব ফিরে পেতে লড়ে চলেছেন। সেই পথে বাধা হয়ে আছে ইরানের একলা চলার নীতি এবং সৌদি রাজবংশের খামখেয়ালি স্বভাব। তবু ১৭০কোটি অভিভাবকশূন্য মুসলিম জাতি  একজন বন্ধু পেল একজন অভিভাবক পেল। ইহাই আশার বানী।

সহযোগী সম্পাদক, ফেনীর কথা ডট কম
nazimsarkar@gmail.com

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo