পাভেল হায়দার চৌধুরী-নদীর বুকে দৃশ্যমান এখন পদ্মা সেতু। শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) এই সেতুর পিলারের ওপর বসানো হয়েছে প্রথম স্প্যান। আর এরই মধ্য দিয়ে সব বাধা পেরিয়ে পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন থেকে বাস্তবে, পুরোপুরি বাস্তবায়নের পথে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস ও অদম্য আত্মবিশ্বাসেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সাফল্য দেখাচ্ছে সরকার।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর দূরত্ব ঘোচাতে পদ্মা নদীর ওপর সেতু তৈরির স্বপ্ন দীর্ঘদিনের।দেশের সব রাষ্ট্রনায়ক ও সরকার প্রধান এ স্বপ্নপূরণের উপায় খুঁজেছেন কিন্তু, সফল হতে পারেননি কেউ। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি উল্লেখ করেছিল আওয়ামী লীগ। বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। বিশ্বব্যাংকসহ আরও কিছু দাতা সংস্থা শুরুতে এর সঙ্গে যুক্ত হলেও কথিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে সংস্থাগুলো পিছু হটে যায়। কিন্তু,অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাসের কারণে এই সেতু নির্মাণের স্বপ্ন থেকে এক বিন্দুও সরে আসেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মাসেতুর অগ্রগতি সাধনে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো যখন এই প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন পদ্মাসেতু হবে নিজেদের অর্থায়নে। এরপর থেকেই পদ্মাসেতুর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দেশের সাধারণ মানুষ। বিরোধী রাজনৈতিক মহলসহ বিভিন্ন পক্ষ এ ঘোষণাকে হেসে উড়িয়ে দিলেও নিজের সংকল্পে অটল থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে উদাত্ত আহবান জানান তহবিল সংগ্রহে সহযোগিতার জন্যে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, সচিব, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণ ও প্রবাসীরা প্রধানমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে পদ্মাসেতুর তহবিলে টাকা পাঠানো শুরু করেন। ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছর থেকে বাজেটেও সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা শুরু হয়।
কথিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে এসব বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ দাতাসংস্থাগুলো নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে চাইলে সরকার খানিকটা বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল তখন। এরপর ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি সরকার বিশ্বব্যাংকে চিঠি দিয়ে তহবিল বিবেচনার আবেদন প্রত্যাহার করার চিঠি দেয়। অবশ্য এ সময় চীন মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশ পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করলেও সুবিধাজনক না হওয়ায় বাংলাদেশ তাতে আগ্রহ দেখায়নি।
২০১২ সালের ১০ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু নির্দেশ দেন। ওই সময় প্রস্তুতিমূলক কাজ দ্রুত শেষ করতে নির্দেশ দেন তিনি। এরপর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মূল সেতুর কার্যক্রম শুরু করা হয় নিজেদের অর্থায়নেই।
বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জমি অধিগ্রহণসহ আনুষাঙ্গিক কিছু কাজের জন্য প্রতিটি অর্থ বছরে কম বেশি বরাদ্দ রাখলেও মূল সেতু নির্মাণে প্রথম বরাদ্দ রাখা হয় ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের বাজেটে। ওই বাজেটে পদ্মা সেতুর জন্য ৬ হাজার ৮শ’ ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এরপর থেকেই প্রতিটি অর্থ বছরে বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখা হয় পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ রাখা শুরু করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৪-২০১৫ সালে রাখা হয় ৮ হাজার ১শ’ কোটি টাকা। ২০১৫-২০১৬ সালে বরাদ্দ রাখা হয় ৭ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে বরাদ্দ রাখা হয় ৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয় ৫ হাজার, ৫শ’ ২৪ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফলউল্যাহ বলেন, শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সাহস ও শক্তি পদ্মাসেতু আজ দৃশ্যমান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সততার শক্তি ছিল বলেই চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, শেখ হাসিনার অদম্য আত্মবিশ্বাসই জনগণের স্বপ্নের পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, বিজয়ীও হয়েছেন।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর অর্থায়ন স্থগিত করে। ঋণচুক্তির মাত্র ৫ মাসের মাথায় দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। অন্য দাতা সংস্থাগুলোও একে একে বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করে। যদিও ঋণচুক্তি স্থগিতের সময় ঋণ পুনর্বিবেচনায় জন্য দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ চারটি শর্তজুড়ে দেয় দাতা সংস্থাটি। এ সময় দু’দফায় বিশ্বব্যাংক ‘দুর্নীতি’র কিছু তথ্য প্রমাণও বাংলাদেশকে দেয়। সরকারের তরফ থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে নানা দেন দরবার চলতে থাকে। প্রকল্প পরিচালকের চুক্তি বাতিল যোগাযোগ সচিবকে সরিয়ে দেওয়াসহ কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপও সরকার এ সময় নেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে তা সন্তোষজনক না হওয়ায় ২০১২ সালের ২৯ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে।
কিন্তু এতকিছুর পরও টলানো যায়নি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দেন। নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করা হবে ঘোষণা দিয়ে এসময় তিনি বাংলাদেশী ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের পদ্মা সেতু নির্মানে সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা দরিদ্র হতে পারি। প্রয়োজনে রিজার্ভ থেকে বছরে এক-দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করা মোটেই কষ্টের কিছু নয়। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অপবাদ দিয়েছে।
২০১২ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে পদ্মা সেতুর অর্থ সংগ্রহে প্রতিটি তফসিলি ব্যাংকে দুটি করে ব্যাংক হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ আগস্টের নির্দেশনায় তফসিলি ব্যাংকগুলো হিসাবও খোলে। মন্ত্রিসভার সভার বৈঠকে সরকারের সকল মন্ত্রী তাদের এক মাসের সম্মানী পদ্মা সেতু ফান্ডে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সচিবরাও একটি উৎসব ভাতার সমপরিমাণ অর্থ পদ্মা সেতু ফান্ডে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অর্ধ শতাধিক সচিব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই অর্থ নির্ধারিত ব্যাংকে জমাও দিয়ে দেন।
অবশেষে শেখ হাসিনার অদম্য আত্মবিশ্বাসের কাছে হার মেনেছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ষড়যন্ত্র। কোনও কিছুই স্বপ্নের পদ্মাসেতুর কাজ আর থামাতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা সবগুলো দাতা সংস্থা পিছু হটে গেলেও মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি শেখ হাসিনার। পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগ আসে নিজের পরিবারের সদস্যদের ওপরও। সব দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে শেখ হাসিনার সরকার আজ দৃশ্যমান করতে সক্ষম হয়েছে সেতুর কাজ।
এ প্রসঙ্গে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক নেতৃত্ব ও সাহসিকতায় পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেন,‘বিশ্বব্যাংক যখন এই প্রকল্প থেকে তাদের কাজ গুটিয়ে নিয়েছিল, তখন পদ্মা সেতু প্রকল্প অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা পড়ে। পরে শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তে মেঘ কেটে গেছে। আজ পদ্মা সেতু রঙিন কোনও স্বপ্ন নয়, আজ তা বাস্তব। আজ পদ্মা সেতু পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে দৃশ্যমান। ওবায়দুল কাদের বলেন, এখানে অবদান আছে সবার; সচিব, প্রকল্প পরিচালক, জনপ্রতিনিধি, পদ্মার দুই পাড়ের জনগণ, সেনাবাহিনীর।’
পদ্ম সেতু নির্মাণের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে সরকারের তরফ থেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করা হয়।এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি দোষারোপ করা হয়েছে দ্বাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংককে ও তাকে ঘিরে পশ্চিমা বিশ্বকে। এছাড়া দেশীয় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে সরকারি দল থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ এসেছে। বিশেষ করে নোবেল শান্তি বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসকে এ জন্য দায়ী করা হয়। অভিযোগ করা হয়, অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের পদে থাকতে না পেরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছেন।