আলমগীর কবির- রক্তের দরিয়ায় রোহিঙ্গারা রক্তের দরিয়ায় রোহিঙ্গারা ‘নিথর দেহ পড়ে আছে বাড়ির উঠানে, ধানক্ষেতে। কারো লাশ পড়ে আছে বাড়ির পাশের খাল বা পাহাড়ের পাদদেশে। শত শত মৃতদেহ দেখা গেছে রাস্তায়। বাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছে। কেউ কেউ জঙ্গলে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় এপারেও আসা যাচ্ছে না। যারা বেঁচে আছে তারা নিহতদের লাশ দাফন করছে। কিন্তু ভাগ্যে জুটছে না কাফনের কাপড়।’ গত বৃহস্পতিবার থেকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোর চিত্র এমনটিই ছিল বলে জানা গেছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকারে তারা জানান, রাখাইন রাজ্যে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার সাত শতাধিক রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে সে দেশের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী। শুক্রবার রাতে সেখানকার কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার পর থেকে রোববার পর্যন্ত মংডুর উত্তরাঞ্চলের গ্রাম রাথিডং, হাতিপা, খোয়ারিপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে এই হত্যাযজ্ঞ চালায় সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী। লন্ডনভিত্তিক আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কো কো লিন বলেন, আরসার হামলার সাথে সাধারণ রোহিঙ্গাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা একদম অসহায়। সরকারি বাহিনীর নতুন করে হামলা শুরুর প্রথম দুই দিনে সাত শ’ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এখনো থামেনি হত্যাযজ্ঞ। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয় দফতর (ওসিএইচএ) সোমবার তাদের সর্বশেষ হালনাগাদকৃত তথ্যে জানিয়েছে, রাখাইনে সংঘর্ষের পর ২৪ থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত সেখানকার পাঁচ হাজার ২০০ লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারে পৌঁছেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ কেন আবার এই সহিংসতা বাড়ল? বিশ্লেষকেরা এর জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনী এই চলমান সংঘর্ষে উসকানিদাতা হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন তারা। পুলিশ পোস্টে রোহিঙ্গাদের ২৫ আগস্টের হামলার অভিযোগ যদি সত্য হয়েও থাকে, তবে তা দীর্ঘ দিনের নিপীড়িত মানুষের জমে থাকা ক্ষোভের প্রতিফলন। তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এমন উসকানিমূলক আচরণ সামরিকীকরণের কৌশল বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। সেই সাথে রাখাইন রাজ্যে ভয় ও উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়াও একটি লক্ষ্য ছিল এমন আচরণের মধ্যে। বিশ্লেষকদের দাবি, এই প্ররোচনা মূলত ছড়ানো হয়েছিল মিয়ানমারে গঠিত কফি আনানের অ্যাডভাইজরি কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাখানের জন্য। এই কমিশন ২৫ আগস্ট অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি দলের কাছে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ৮৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। ঠিক সে দিনই হামলা হয় পুলিশ ফাঁড়িতে। আনান কমিশনের সুপারিশে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চলাচলের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। ঠিক সেই সময়ই এমন আচরণকে পরিকল্পিত বলেই মনে করছে অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এই কমিশন গঠিত হয় সাবেক জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে। রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন রাজ্যের রাজধানী সিত্তেয় প্রথম এসে পৌঁছেছিলেন গত বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে। এসেই বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের ব্যানারে ছিল ‘বিদেশীদের পক্ষপাতদুষ্ট হস্তক্ষেপের’ প্রতিবাদসংবলিত নানা লেখা। মূলত এই কমিশন গঠিত হওয়ার সময় থেকেই মিয়ানমারের বেশ কিছু পার্টি যেমন- তাতমাদও, ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, মা বা থা ইসলামোফোবিক মংক অর্গানাইজেশন এবং রাখাইন ন্যাশনালিস্ট যৌথভাবে সেটাকে অস্বীকার করেছিল। আর ঠিক যে দিন মিয়ানমার সরকার কমিশনের দেয়া সুপারিশগুলোকে স্বাগত জানাল সে দিনই এ হামলার ঘটনা ঘটল, এটা মোটেও আকস্মিক ঘটনা নয় বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ কমিশনের রিপোর্টে কিভাবে রাখাইনে উত্তেজনা নিরসন ও সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের অবসান ঘটানো যায় সে সম্পর্কে সুপারিশ ছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। একটু পেছনে তাকালে দেখা যায়, ৯ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন আইনপ্রণেতাদের একটি মিটিং হয়। ১৩ আগস্ট বিক্ষোভ করে রাখাইন চরমপন্থীরা। ১৫ আগস্ট রথেদংয়ে এক কৃষকের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১৮ আগস্ট সেখানেই আরেক রোহিঙ্গা পরিবারের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। পরদিন রথেদংয়ে এক জেলের শিরñেদ করা হয়। এর আগে ৪ আগস্ট একই এলাকায় চালানো হয় পুলিশি অভিযান। তারও আগে নিষিদ্ধ করা হয় রোহিঙ্গাদের কেনাকাটা। ২৩-২৪ আগস্ট রথেদংয়ে চলে গণগ্রেফতার। এরপর ২৫ আগস্ট রথেদং বুতিদং ও মংডুতে পুলিশ পোস্টে হামলার অভিযোগ ওঠে। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর বক্তব্য, সেনাবাহিনীই মূল উসকানিদাতা এসব সংঘর্ষের পেছনে। রাখাইন রাজ্যে গত পাঁচ বছরের সহিংসতায় শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরো প্রায় দুই লাখ। হতাহতের শিকার ও বাড়িঘর থেকে উৎখাত হওয়া এসব মানুষের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। এ পরিস্থিতিতে রাখাইন সমস্যায় আন্তর্জাতিক মহলের সম্পৃক্ততা এখন ক্রমবর্ধমান তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন। পর্যবেক্ষকেরাও সতর্ক করে বলেন, এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে দৃশ্যত বহুদূরে বলেই মনে হচ্ছে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করছেন অং সান সু চির দল। যদিও সেনাবাহিনীর চাপে সরকার পরিচালনার পুরোপুরি স্বাধীনতা পাচ্ছে না দলটি। তাই আক্ষরিক অর্থে এটি গণতান্ত্রিক সরকারের আড়ালে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত একটি সরকার। সরকারের পরোক্ষ বাধার কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন এবং রোহিঙ্গাদের সাথে সঠিকভাবে আনান কমিশন কথা বলতে পারেনি। সামরিক বাহিনীর ওপর দেশটির উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রভাব কম নয়। কিছু উগ্র ভিক্ষুর নেতৃত্বেই শুরু হয়েছিল রোহিঙ্গাবিরোধী দাঙ্গা। সব কিছু মিলিয়েই মিয়ানমারে সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হতে হচ্ছে বছরের পর বছর। সরকারের সুনির্দিষ্ট ভূমিকার অভাবে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন অপরিবর্তিত রয়েছে। যার ভুক্তভোগী শুধু মিয়ানমারই নয়, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যদেরও সইতে হয়। নোবেলজয়ী ও দেশটির বর্তমান সরকারের কার্যত প্রধান অং সান সু চির ক্ষমতা গ্রহণে সংখ্যালঘু ও আন্তর্জাতিক মহল আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না পারায় অং সান সু চি এই রোহিঙ্গা ও সংখ্যালঘু পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমাধান দিতে অক্ষম। এ সঙ্কটময় মুহূর্তে দক্ষ ভূমিকা না রাখতে পারায় মানবাধিকার কমিশন ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে অব্যাহত চাপ থাকবে মিয়ানমারের ওপর। দেশটির ভবিষ্যৎও নির্ভর করছে এ সমস্যার একটি সুন্দর সমাধানের ওপর; পরিস্থিতি যতটা নাজুক এ মুহূর্তে তাতে সরকারের মৌন ভূমিকা দেশটিকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, যার প্রধান ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে তাই এ সমস্যা দ্রুত ও সুষ্ঠু সমাধানের আশায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আবেদন করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই দায় শুধু মিয়ানমার সরকার বা দেশ একা দোষী নয়, বরং এ পরিস্থিতি বন্ধে সুর্নিদিষ্ট ভূমিকা না রাখতে পারায় আন্তর্জাতিক মহলও দায়ী থাকবে নির্যাতিত এ মানুষদের কাছে।