এই প্রথম দেশে এক দিনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা হাজার ছাড়াল। গত দুই মাসে আর কখনও এক দিনে এত রোগী বাংলাদেশে শনাক্ত হয়নি। এক হাজার ৩৪ জন নতুন রোগী শনাক্তের পাশাপাশি এদিন মারা গেছে আরও ১১ জন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকায় ৮ জন, চট্টগ্রামে ২ জন এবং রংপুরে ১ জন। এই সময়ে মোট ৭ হাজার ২৬৭টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে ৭ হাজার ২০৮টি। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত দেশে ১৫ হাজার ৬৯১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর তীব্র ছোঁয়াচে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছে ২৩৯ জন। সোমবার নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির সর্বশেষ এ তথ্য তুলে ধরেন।
এদিকে দেশে লকডাউন শিথিলে করোনা সংক্রমণের হার প্রতিদিনই বাড়ছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত যেখানে প্রতিদিন নতুন করোনায় শনাক্তের সংখ্যা ৫শ থেকে সাড়ে ৫শ জনে ওঠানামা করছিল, সেখানে মে মাসের শুরু থেকেই তা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সংখ্যার এই ঊর্ধ্বগতি চলতি মে মাসটিকে আরও বেশি নিষ্ঠুর করে তুলতে পারে এমনটাই বলে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। গত এক সপ্তাহে আক্রান্ত ও মৃতর সংখ্যার দিকে তাকালে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পোশাক কারখানা চালু করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত পোশাক শ্রমিক পাওয়া গেছে। গাজিপুর ও নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানার আশপাশে রোগী বাড়ছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ চালুর কারণে মানুষের ভিড়ও বেড়েছে সেসব স্থানে। বিপণিবিতানগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও লোকসমাগম হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছুই খোলার পক্ষে সরকার। এসবের মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ নগরী ঢাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী বরাবরের মতো ঢাকা মহানগরীতে রোগ শনাক্ত এবং মৃত্যুর হার দুইই বেশি। তীব্র ছোঁয়াচে এই রোগে আক্রান্তের সর্বোচ্চ পর্যায়টি কী হবে তাও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে করোনা পরীক্ষা শুরু হওয়ায় এখন দেশে মোট ৩৭টি পরীক্ষাগারে এ ভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষার আওতা বাড়ায় রোগ শনাক্তের সংখ্যাও বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৫২ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। মোট সুস্থ দুই হাজার ৯০২ জন। দেশে রোগ শনাক্তের সংখ্যা অনুযায়ী সুস্থ হওয়ার হার ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫৩ শতাংশ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
স্বাস্থ্য বুলিটিনে তিনি জানান, গত এক দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে পাঁচজন পুরুষ, ছয়জন নারী। তাদের মধ্যে একজনের বয়স ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে, একজনের বয়স ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে, চারজনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরেরর মধ্যে, দুইজনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, দুইজনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এবং একজনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মনোবল শক্ত রাখার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, যারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা কখনই মানসিক মনোবল হারাবেন না। আপনি মানসিকভাবে উজ্জীবিত থাকলে আপনার শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম বা প্রতিরোধ ক্ষমতা অবশ্যই বেড়ে যাবে। মানসিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেমটা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। আপনারা এ দিকে খেয়াল রাখবেন।
মানসিক শক্তি বাড়ানোর উপায় তুলে ধরে নাসিমা সুলতানা আরও বলেন, সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে নিজেরা জড়িত থাকি, শিশুদেরকে জড়িত থাকতে উদ্বুদ্ধ করি। সবচেয়ে বড় কথা আমরা যেকোনোভাবে নিজেদেরকে ভালো রাখার চেষ্টা করব। তাহলে আমরা এই যুদ্ধ নিশ্চয় জয় করতে পারব। সবসময় পুষ্টিকর খাবার খাবেন। বেশি করে পানি ও তরল খাবার খাবেন। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ শাকসবজি, ফলমূল খাবেন। এই খাবারগুলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে বলেও জানান তিনি।
ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে ১৮৩ জনকে, বর্তমানে আইসোলেশনে আছে মোট ২ হাজার ২৩৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে এসেছে দুই হাজার ৩৬০ জন। এ পর্যন্ত আইসোলেশনে এসেছে দুই লাখ ১২ হাজার ৯৮৩ জন।
তিনি বলেন, সারা দেশে ৬৪ জেলায় ৬১৫টি প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য প্রস্তুতি। তাৎক্ষণিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের সেবা দেওয়া যাবে ৩০ হাজার ৯৫৫ জনকে।
তিনি বলেন, সারা দেশে আইসোলেশন শয্যা আছে আটশ হাজার ৬৩৪টি। ঢাকার ভেতরে আছে দুই হাজার নয়শটি। ঢাকা সিটির বাইরে পাঁচ হাজার ৭৩৪টি শয্যা আছে। আইসিইউ সংখ্যা আছে ৩২৯টি, ডায়ালাসিস ইউনিট আছে একশ দুইটি।
গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের আঘাত আসে। এরপর এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগীর খোঁজ মেলে গত ৮ মার্চ; তার দশ দিনের মাথায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সোমবার সকাল পর্যন্ত করোনায় বিশ্বব্যাপী নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৮৬০ এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৪১ লাখ ৮০ হাজার ৩০৩। অপরদিকে ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৭৭৬ জন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।