কথা ডেস্ক-হাতের তালু বা করতলের রেখা আর নকশাগুলো নিয়ে আমাদের কৌতূহল স্মরণাতীতকাল থেকে। হস্তরেখাবিশারদ বা গণকঠাকুররা এই তালু দেখে ভূত-ভবিষ্যতের সব কিছু বলে দেয়ার দাবি করে থাকেন। হাতের তালুতে ভাগ্যরেখা আছে কি না, তা নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক, পেশাদার বা শৌখিন হস্তরেখাবিদের দেখা পেলে অনেকেই হাতটি বাড়িয়ে দেন। তবে ভাগ্যের কথা বাদ দিলেও আরো অনেক তথ্য দিয়ে থাকে হাতের তালু। বিশেষ করে আমাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে হাত দেখেই অনেক কিছু জানা সম্ভব।
বিশেষ করে মধ্যযুগে হাত দেখেই চিকিৎসকরা বিভিন্ন রোগ, ইনফেকশন ও সার্বিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জেনে নিতেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, এটা রকেটবিজ্ঞান নয়। তাই সবাইকে এটা কোনো সূত্রের সাহায্যে জানতে হবে বিষয়টা তেমন নয়। তবে আমরা আমাদের হাতের সাথে নিজেদের অবস্থা মিলিয়ে অনেক কৌতূহলের অবসান করতে পারি।
কারো কনিষ্ঠ বা কড়ে আঙুল (little fingers) দু’টি যদি প্রায়ই অসাড় হয়ে পড়ে, তবে তার উচিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা। কারণ এ ধরনের সমস্যা হৃদপিণ্ড ও রক্তবাহী নালীব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। আবার কারো বুড়ো আঙুলে ( thumbs) বোধশক্তি না থাকলে বুঝতে হবে তার শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যবস্থায় গলদ রয়েছে।
কারো হাতের তালু দু’টি লাল হয়ে যাওয়াটা তার যকৃতের কার্যমতায় সমস্যা সৃষ্টির কথা বোঝায় : তার হেপাটাইটিস কিংবা হেপাটোসিসে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তালু দু’টি যদি মার্বেলের মতো সাদা, মসৃণ হয় তাতে নার্ভাস সিস্টেমের ভেঙে পড়ার লণ বোঝায়। তালুর রঙ যদি হয় হলদেটে, তবে হয় তার লিভার বা গলব্লাডারের সামর্থ্য কমে গেছে কিংবা রোগী হেপাটাইটিস, গলস্টোন বা বিলারি ট্র্যাক্ট ডিজিজ, চোলাঙ্গিটিস বা চোলেসাইস্টিটিসে আক্রান্ত হয়েছে।
হাতের পেছনে বাদামি বাদামি স্পট দেখা যাওয়া শুধু তার বয়সের কথাই জানান দিচ্ছে না (বিশেষ করে প্রবীণদের চামড়ার রঙ বদলে যাওয়ার ইঙ্গিতবাহী), সেই সাথে এটাও বোঝাচ্ছে, তার গলব্লাডারের সমস্যা রয়েছে।
কারো হাতের বিশেষ করে তালুর চামড়া উঠে যেতে থাকে, তবে তা খুব সম্ভবত তার দেহে ভিটামিন ও ও ডি’র অভাবের কথাই স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে।
কারো আঙুলের ডগাগুলো রক্তবর্ণ ধারণ করলে তার হজমব্যবস্থার দিকে নজর দেয়া উচিত। সেখানেই গণ্ডগোল হয়েছে ধরে নেয়া যায়। আঙুলের ডগার রঙ গাঢ় লাল বা নীলচে হওয়াটা কিডনি ও লিভার সুস্থ নেই বলে ধরে নেয়া যায়। ‘মাউন্ট অব ভেনাস’ (হস্তরেখাবিশারদরা বুড়ো আঙুলের গোড়ার দিকে ফুলে যাওয়াকে এই পরিভাষায় প্রকাশ করে থাকেন) দিয়ে যৌনাঙ্গগুলোর সম্ভাব্য সমস্যার কথা জানাচ্ছে।
ডান হাতের তর্জনীতে (index finger) চুলকানির অর্থ বোঝাতে পারে স্নায়ুসঙ্কোচন ব্যবস্থায় (peristalsis) সমস্যা রয়েছে। আর তর্জনির পেছনের চামড়ায় খসখসে অবস্থা প্রায়ই গলব্লাডারের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে।
হাতের তাপমাত্রাও স্বাস্থ্যের পরিমাপক। হাত যদি নিয়মিত ঠাণ্ডা থাকে তবে তা নিক্রোটিনিক অ্যাসিডের (ভিটামিন বি৩) ঘাটতির ফলে হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে হয় ভিটামিন ওষুধ গ্রহণ করতে হবে কিংবা এই ভিটামিনসমৃদ্ধ দুগ্ধজাতসামগ্রী, গোশত, মাছ, মাশরুম, শিম, কপি ইত্যাদি বেশি বেশি গ্রহণ করতে হবে। হাতের তালুর জ্বালাপোড়া যকৃতে বিষক্রিয়ার ইঙ্গিতবাহী। ওষুধের বিষক্রিয়া, অ্যালকোহল বা অন্য কোনো রাসায়নিক গ্রহণের কারণে এটা ঘটতে পারে।
হাতের তালুতে কোঁচকানো (crawling chills) লণ এনডোক্রাইন সিস্টেমের (endocrine system) সম্ভাব্য সমস্যা প্রকাশ করতে পারে। ভেজা তালু এনডোক্রাইন (endocrine) সমস্যার পাশাপাশি খুব সম্ভবত হাইপারথাইরোইডিজম- থাইরয়েড গ্রন্থির অতিরিক্ত কার্যকারিতার ইঙ্গিতবাহী। শুষ্ক ও ফ্যাকাসে তালু থাইরয়েড গ্রন্থি বা হাপোথিরোইডিজমের তুলনামূলক কম কার্যকারিতার ইঙ্গিতবাহী।
জোড়াগুলোর দিকে নজর দিয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। অতিরিক্ত নমনীয় জোড়া (বিপরীতক্রমে, অতিরিক্ত শক্ত জোড়া) এবং সেই সাথে মাংসপেশির সাধারণ দুর্বলতা বোঝায় গলব্লাডার ঠিকমতো কাজ করছে না। আঙুল ফোটার শব্দ নিশ্চিতভাবেই দেহে ক্যালসিয়ামের অভাব বোঝাতে পারে। হাতের জোড়ায় বেদনাদায়ক বাঁকানো অবস্থা অস্থিতে সন্ধিপ্রবাহ ও ক্ষয়রোগের (osteoarthritis) প্রকাশ। গেঁটেবাতে আক্রান্ত লোকজন প্রায়ই এই রোগে আক্রান্ত হয়। যদি জোড়াগুলো একটু বেশি বড় মনে হয় এবং বিশেষ ধরনের লালচে ভাবসহ বেদনাদায়কভাবে বাড়তে থাকে, তবে পলি-আর্থ্রাইটিসের (poly-arthritis) সন্দেহ করা যায়। তর্জনী (index) ও অনামিকার (ring fingers) দ্বিতীয় ও তৃতীয় জোড়াগুলোতে ব্যথা হলে বুঝতে হবে আপনি হাঁটুর জোড়ার রোগে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন।
হাত দু’টি বড় বড় হওয়াটা অপোকৃত ভালো স্বাস্থ্যের কথা প্রকাশ করে থাকে। তবে যাদের হাতের তালু বড়, কিন্তু আঙুলগুলো ছোট ছোট, তারা প্রায়ই রক্ত সঞ্চালন সমস্যায় বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপে ভুগে থাকে।
যাদের হাত কিছুটা ছোট, অথচ অস্থিগুলো বড় বড়, তাদের নার্ভাস সিস্টেম বেশ দুর্বল। ফলে তারা যেকোনো ধরনের পরিবর্তন, যেমন আবহাওয়া বা তাপমাত্রা, টাইম জোন বা আবেগমূলক চাপে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকে। ছোট পরিপাটি হাতওয়ালা লোকরা বাড়তি নার্ভাস সিস্টেমের অধিকারী হয়। তাদের অবশ্য হাঁপানি, মলদ্বারের রোগ (inflammation of the rectum) ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণ ‘মাংসল’ তালুর অধিকারীরা কম রক্তচাপ, হজমে মন্দা ও থাইরয়েড হাইপো-ফাংশনে আক্রান্ত হতে পারেন।
নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গের অবস্থাভেদে ব্যথাও বিশেষ কিছু রোগের কথা প্রকাশ করে। চীনা চিকিৎসকদের অভিমত, তালুর কেন্দ্র হলো পুরো দেহের জ্বালানি কেন্দ্র। আপনার এক হাতের তালুতে অপর হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে জোরে চাপ দিন, যদি হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন, তবে বুঝতে হবে আপনার মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। আপনি এখনো কিছুই বুঝতে না পারলেও খুব তাড়াতাড়ি আপনি তাতে আক্রান্ত হবেন।
এবার আপনার বুড়ো আঙুল অপর হাতের বুড়ো আঙুলের পেছনে রাখুন এবং তর্জনীকে রাখুন ভেতরের দিকে। এবার জোরে চাপ দিন। প্রচণ্ড ব্যথা হলে বুঝবেন, আপনার হৃদপিণ্ডে সমস্যা আছে এবং খুব সম্ভবত আপনি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন।
মধ্যমা (middle fingers) ও অনামিকার (ring fingers) মধ্যে প্রচণ্ড ব্যথা জেনিটো-ইউরিনারি সিস্টেমে সমস্যার কথা বোঝাচ্ছে। আপনার কড়ে (little fingerring fingers) ও অনামিকা আঙুলের মধ্যবর্তী স্থান থেকে কব্জি পর্যন্ত একটি কাল্পনিক রেখা টানুন। এই রেখার নিচের তৃতীয়াংশে (কব্জি থেকে) লিভার ও গলব্লাডারের অবস্থান। তাই এই স্থানটিতে চাপ দিলে ব্যথা অনুভব করলে আপনার এসব অঙ্গের সমস্যার বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন।
এই ‘হস্তরেখা বিজ্ঞান’ পড়ে আপনি আপনার দেহের বিভিন্ন সম্ভাব্য সমস্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে পারেন। তবে এটাও মনে রাখবেন, এটাই সব নয়। এই ‘হস্তরেখা’ বিশ্লেষণ করে আপনি যে ধারণা পাবেন, সেটাকে নিয়ে বসে না থেকে আপনাকে আরো কিছু করতে হবে। সেটা কিভাবে করবেন তা আপনার ব্যাপার।