বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধিত বৈদ্যুতিক শক্তির দেশ এখন বাংলাদেশ। আশির দশকের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বাংলাদেশ এখন শিল্পনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নব্বই এর দশক থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত উদীয়মান পরাশক্তি চীনের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪৬%। অথচ গত ১০বছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৩৮৯%। দেশের এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৯,২০২মেগাওয়াট, ২০০৯সালে যা ছিল মাত্র ৪৯৪২মেগাওয়াট। গত ৯বছরে দেশে নতুন ১২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। বিদ্যুতের উপর চাপ কমাতে বড় বড় শিল্পকারখানাকে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করে নিজেদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে উৎসাহিত করা হয়।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে দেশের ৪৬% বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। আন্তঃসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে ভারত, নেপাল, মায়ানমার ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানী করার পরিকল্পনা করা হয়। ভারত থেকে ইতিমধ্যেই ৬৬০মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানী করা হচ্ছে, এইসব লাইন ব্যবহার করেই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে প্রতিবেশি দেশসমুহে বিদ্যুৎ রপ্তানিও করতে পারবে।
স্বাধীনতার পরে গ্যাসকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। তাই বাংলাদেশের ৬০% পাওয়ার প্লান্ট গ্যাস নির্ভর। বর্তমান সরকার গ্যাসের উপর চাপ কমাতে এবং জ্বালানীর বৈচিত্র্যতা আনতে পাবনা জেলার রুপপুরে রাশিয়ার সহযোগিতায় ২৪০০মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে, যা ২০২৩সালে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে টেকসই ও নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) গঠন করা হয়েছে।
রামপাল, পায়রা এবং মাতারবাড়িতে আমদানীকৃত কয়লা নির্ভর প্রায় ৬০০০মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুত কেন্দ্র গড়ে উঠছে। আগামীতে পায়রা এবং মাতারবাড়ি হবে বাংলাদেশের পাওয়ার হাব। বর্তমানে দেশের ৯০% জনগন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভুক্ত। নতুন ৩১২২কিঃমিঃ সঞ্চালন লাইন ও ১লক্ষ ৯৭হাজার কিঃমিঃ বিতরন লাইন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌছিয়ে দিচ্ছে। ২০৩০সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৮হাজার মেগাওয়াটকে সামনে রেখে চলছে বাংলাদেশ সরকারের কর্মযজ্ঞ। গত মাত্র ৯বছরে ১লক্ষ ৩০হাজার বৈদ্যুতিক মিটার সংযোগ দেয়া হয়। বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নে এডিপিতে বার্ষিক বরাদ্ধ দেয়া হয় ২৬হাজার কোটি টাকা। সিস্টেম লস কমিয়ে আনা হয় ৫.৪৫%। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পিডিবিকে ভেঙ্গে করা হয় ৭টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি এবং ৬টি বিদ্যুৎ বিতরন কোম্পানি। গ্রাহকসেবা বাড়াতে প্রি-পেইড মিটার এবং অনলাইনে সংযোগের আবেদনের ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যুৎ বিতরনকে আরো মানসম্পন্ন করতে দেশে প্রথমবারের মত ৭৬৫কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মিত হচ্ছে মাতারবাড়ি থেকে ঢাকা পর্যন্ত। বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১০টি প্রকল্পের ৩টি প্রকল্প হচ্ছে বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের। প্রায় ১লক্ষ ৬৩হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে।
একটি দেশের জিডিপি এবং ইনফ্রা-স্ট্রাকচার উন্নত করার জন্য প্রয়োজন বিদ্যুতের প্রাপ্যতা। তাই সরকারের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন এবং জাতিসংঘের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে ২০১৯সালের মধ্যে বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠী শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে। ২০৪০সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৬০হাজার মেগাওয়াট। ৮বছর পূর্বেও যেখানে দেশে লোডশেডিং ছিল নিত্য ঘটনা। ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষকে বিদ্যুতের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বলছে বাতি ঘুরছে পাখা, নেই অসহনীয় লোডশেডিং। কারন বিদ্যুৎ বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ।
প্রকৌশলী নাজিম সরকার
জুনিয়র সহ-ব্যবস্থাপক, জাতীয় গ্রিড