ফেনী
শনিবার, ২রা আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বিকাল ৩:৪১
, ৭ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি

যে দলই জিতুক, সরকার হোক সবার

মহিউদ্দিন আহমদ: খুনোখুনির সংখ্যা যদি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়া বা না হওয়ার নির্ণায়ক হয়, তাহলে আজ অবধি শান্তি বজায় আছে, এটি বলা যেতে পারে। কিন্তু আসলেই কি পরিবেশ শান্ত আছে?

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর ১১ থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ১৯৬টি নির্বাচনী আসনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৭২৬ জন। আক্রান্ত হয়েছেন কমপক্ষে ৪৬ জন প্রার্থী।

অনেকেই আশা করেছিলেন, সেনাবাহিনী মাঠে নামলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। সেটি হয়নি। প্রথম দিন, অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর রাত ৯টা পর্যন্ত অন্তত ১৭ জেলার ২১টি নির্বাচনী এলাকায় হামলা ও সংঘর্ষে ২২৬ জন আহত হয়েছেন। যেটি হিসাবে আসেনি, তা হলো, ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ঢাকার নবাবগঞ্জে একটি অতিথিশালায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁদের কামরাগুলো ভাঙচুর হয়েছে। আহত হয়েছেন ১০ জন সাংবাদিক।

নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও শান্তিপূর্ণ হবে কি না, এ নিয়ে আশঙ্কা ছিল আগে থেকেই। দলীয় প্রতীকে সম্প্রতি কয়েকটি সিটি করপোরেশনে যে নির্বাচন হয়ে গেল, তা নিয়ে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। একটি টিভি চ্যানেলের সংবাদে বলা হচ্ছিল, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ চলছে। কিন্তু সংবাদচিত্রে আমরা দেখলাম, ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তা ও পুলিশের উপস্থিতিতেই ব্যালট পেপারে যথেচ্ছ সিল মারা হচ্ছে। কোথাও বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। একজন বিশ্লেষক বলেছেন, এটি ছিল ‘শান্তিপূর্ণ কারচুপি’র উদাহরণ। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক তখন দাবি করেছিলেন, সিটি করপোরেশনের ভোট সুষ্ঠু হয়েছে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনও এ রকম হবে। ওই নেতার কথা অনেকটাই প্রফেটিক। তবে তা অর্ধসত্য। নির্বাচনটি ওই রকমই হতে যাচ্ছে। তবে তা আর শান্তিপূর্ণ থাকছে না। প্রতিদিনই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

মাঠে যেসব সংঘর্ষ হচ্ছে, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া যচ্ছে। কোথাও কোথাও হামলা করেছেন প্রতিপক্ষ দলের কর্মী-সমর্থকেরা। আবার কোনো কোনো জায়গায় নিজ পক্ষের বঞ্চিত প্রার্থীর ক্ষোভের প্রকাশও শোনা যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে এটি নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছে, যা পরে গবেষণার বিষয় হবে।

এ দেশে সরকারি দলের অধীনে নির্বাচন হলে বিরোধী দল কখনোই জেতে না। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমরা এই হাইপোথিসিসটির প্রমাণ দেখেছি বারবার। প্রতিবারই দেখা গেছে, বিরোধীপক্ষ থেকে কারা সংসদে আসবেন, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই নির্ধারণ করে দেয় সরকারপক্ষ। কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, এবার কি তার ব্যত্যয় হবে?

এখন কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হয়। আমি হয়তো একটা পূর্বাভাস দিলাম। কারও কারও মনে হতে পারে—ব্যাটা গুজব ছড়াচ্ছে। আইসিটি আইন তো গর্দানের ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন চান না। অর্থাৎ আরেকটি ওয়াকওভার নেওয়ার ইচ্ছে নেই তাঁর। তিনি চান একটি ভালো নির্বাচন। নভেম্বরের পয়লা সপ্তাহে তিনি সব দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মুখোমুখি বসেছেন, কথাবার্তা বলেছেন। সবাই খুশি মনে ফিরে এসেছেন। একটি ভালো নির্বাচন হলে নিশ্চয়ই তাতে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা বাড়বে। তাঁর মুকুটে সাফল্যের পালক আরেকটি বসবে। তাঁর দল হেরে গেলেও একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাফল্য তিনি দাবি করতে পারবেন। ইতিহাস তাঁকে অমরত্ব দেবে।

কিন্তু এটি ভুলে গেলে চলবে না যে তিনি একটি দলেরও প্রধান। সভাপতি হিসেবে দলকে জেতানো তাঁর দায়িত্ব। এখানে কোনো রকম গড়িমসি চলবে না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটি ভালো নির্বাচন করিয়ে নেওয়া তাঁর দায়িত্ব। একই সঙ্গে নিজ দলকে জেতানো তাঁর দায়। এই দুইয়ের মধ্যে তিনি কীভাবে সমন্বয় করবেন, ভারসাম্য বজায় রাখবেন, সেটি এখন দেখার বিষয়।

বাজারে এখন বেশ কয়েকটি তত্ত্ব জারি আছে। একটি হলো, ভোটের দিন গণেশ উল্টে যাবে। ভোটবিপ্লব হবে। ঐক্যফ্রন্ট-বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কেননা, মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দেবে।

আরেকটি তত্ত্ব হলো, গত এক দশকে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা অভাবনীয়। এই ধারা বজায় রাখতে হলে আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেই। সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর দল জয়ী হলে দেশের মানুষ গরিব থাকবে না। মানুষ কেন ধানের শীষে ভোট দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সময়ের অন্ধকার যুগে ফিরে যেতে চাইবে?

ধরা যাক, গেরস্ত তাঁর ধানের গোলা আর গোয়ালের গরু নিয়ে সুখেই আছেন। তিনি কি চাইবেন, অন্য কেউ এসে তাঁর ঘরে ঢুকে সবকিছু দখল করে নিক এবং তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিক? উপনিবেশ-উত্তর পশ্চাৎপদ সমাজের এটি একটি জনমনস্তত্ত্ব। কেউ হারতে চায় না। এ জন্য আশ্রয় নেয় নানান কৌশলের। জেতার জন্য একটি দল যেসব কৌশল নেয়, প্রতিপক্ষের চোখে তা হলো নীলনকশা, ষড়যন্ত্র। নির্বাচনী কৌশলে আওয়ামী লীগ অনেক এগিয়ে আছে। প্রতিপক্ষ বিএনপি এবং তার সঙ্গীরা এ ক্ষেত্রে অনেকটাই ব্যাকফুটে। তাদের শেষ ভরসা হলো ভোটারের সমর্থন।

ইতিমধ্যে গুঞ্জন উঠেছে, ভোটের ফলাফল নির্ধারিত হয়েই আছে। যাঁরা সরকার গঠন করবেন, তাঁরা বিরোধী পক্ষের কাকে কাকে সংসদে বসার টিকিট দেবেন, সে আলোচনা চলছে এখন। দেখা যাক কার কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে।

নির্বাচন না হওয়া নিয়েও শঙ্কা আছে। তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত আছে এ দেশে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নির্বাচন যে হবে, সেটি তত্ত্বগতভাবে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাবে নির্বাচনের দিন।

আমরা ধরে নিচ্ছি, নির্বাচন হবে। নির্বাচন বর্জন করার মতো সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে কেউ নেবেন বলে মনে হয় না; যদি না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘গুরুতর অবনতি’ হয়। অত্যন্ত বৈরী পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন হয়েছিল।

সংসদীয় রাজনীতিতে নির্বাচন একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। প্রশ্ন হলো, এটি আর প্রতিযোগিতামূলক থাকছে না। দিনকে দিন সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠছে, রাজনীতি হয়ে উঠেছে প্রতিহিংসামূলক। নির্বাচন ঘিরে যা–ই হোক না কেন, নির্বাচন–পরবর্তী সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে অনেকের চোখরাঙানি দেখছি এবং হুংকার শুনছি। ‘দেখে নেব’—এই মেজাজের প্রকাশ কীভাবে ঘটবে, তা আমরা দেখার অপেক্ষায় থাকব।

একটি দল বা জোট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করবে, এটাই স্বাভাবিক। দল সরকারে গেলে তখন সরকার হয় পুরো দেশের। কিন্তু আমাদের দেশে এটি হয়নি। যিনিই প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, তিনি সংসদীয় দলের নেতা হলেও পুরো দেশের প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীদের অবস্থানটিও অনুরূপ। দলের নেতারা দলবাজ হবেন, এটা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু সরকার দলবাজ হবে, এটা কাঙ্ক্ষিত নয়।

একটি দলের যখন সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন তার চারপাশে আগাছা-পরগাছাদের একটা হুল্লোড় পড়ে যায়। মৌ-লোভীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। পদ-পদবির আশায় পদলেহন শুরু হয়ে যায়। পদেরও শেষ নেই। উপাচার্য, বিভিন্ন কমিশনের চেয়ারম্যান-সদস্য, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সরকারের উপদেষ্টা, রাষ্ট্রদূত বা দূতাবাসে চাকরি—এই সব মহার্ঘ পদে নিয়োগ পাওয়ার আকুতি এবং আকুলিবিকুলি তো চরম। এভাবেই গড়ে ওঠে দলের অনুগ্রহজীবী একটি গোষ্ঠী। তারা দলকে ভাসায়, সরকারকে ডোবায়। এই লোভী-পরজীবী গোষ্ঠীটির চেহারা আমাদের চেনা। এরাই সরকারকে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে দেয় না। যাঁরা রাজনীতিবিদ থেকে রাষ্ট্রনায়ক হতে চান, তাঁদের জন্য এটি একটি বড় পরীক্ষা। বিনোদনের জন্য গোপাল ভাঁড় দরকার। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা খুবই সূক্ষ্ম বিষয়। এই বিবেচনাবোধ জাগ্রত হোক, এটাই কামনা। যে দলই জিতুক, সরকার হোক সবার।

মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo
error: Content is protected !!