২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে ১৬ বছরের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও চরম অহংকারী স্বৈরশাসক হাসিনা শাসনের অবসান ঘটে। ৩৬ দিনের এই দেশ-কাঁপানো ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়া গণআন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি যে হাসিনার পতন ডেকে আনবে তা ৫ আগস্টের আগের দিনও কেউ নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেনি। এমনকি ৫ আগস্টের দিন শেখ হাসিনা নিজেও বুঝতে পারেননি যে তাকে চরম অপমানিত হয়ে এভাবে পালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো সরকারপ্রধান, এতোটা করুণ পরিণতির মুখোমুখি হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হননি। আবার এ কথাও সত্য ৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে হাসিনার মতো এতো অহংকারী এর আগে এদেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেনি। হাসিনার মুখের কথাই ছিল আইন। তার ১৫ বছরের শাসন আসল সাজানো ছিল সীমাহীন অত্যাচার, গুম, খুন ও নিপীড়নে পরিপূর্ণ। বাকস্বাধীনতা নেই—এ কথাটা বলার স্বাধীনতাও ছিল না কারো। এ কারণে শুধু আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নয়, বরং আপামর সাধারণ জনগণের মুখে মুখেও শেখ হাসিনার আরেকটি পরিচিতি ছিল ‘লেডি ফেরাউন’ হিসেবে।বাংলাদেশের পোশাক
হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলের নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে এ কথা আমি স্বীকার করবো তার নেতৃত্বে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেলসহ বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এসব উন্নয়ন হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। এখন আমার মতো অনেকের মনেই একটা চিন্তা ঘুরপাক খায় এতো বিশাল ম্যাজোরিটি (Majority) আওয়ামী লীগের জন্য কি ভালো হল?
“Absolute power corrupts absolutely” – এ কথারই বাস্তব রূপায়ন ঘটলো ১৫ বছরের শাসনে।
পিলখানা হত্যাযজ্ঞ, শাপলা চত্বর গণহত্যা, মাওলানা সাঈদীর রায়ের দিন (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) এবং পরের দিন নির্বিচারে গণহত্যা, প্রতিনিয়ত গুম, খুন, বিএনপি জামায়াতসহ বিরোধী নেতাকর্মীদেরকে তার সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল হাসিনার স্বৈরাচারী রাজত্বকালে। কিন্তু এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচারও কোনো উপায় ছিল না সাধারণ মানুষের। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয় হাসিনার সরকার। ফলে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার বলতে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না।
২০১৪ সালের ভোটবিহীন একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের তথাকথিত রাত্রিকালীন নির্বাচন, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন-শেখ হাসিনাকে টানা চারবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছে ঠিকই, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে জনবিচ্ছিন্ন করে হাসিনাকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করেছে। পরিণতিতে, ২০২৪ সালে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে হাজার হাজার প্রাণের বিনিময়ে ইতিহাসের এই নিকৃষ্ট স্বৈরাচারের পতন ঘটে।
হাসিনার পতনের এক বছর পার হলো, কিন্তু আন্দোলনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি। যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট নোবেলবিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে সে স্বপ্ন এখনও পুরোপুরি পূরণ হয়নি। তবে একথা সত্য প্রত্যাশা পূরণে ইউনূস সরকারের অনেক ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতা থাকলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও আছে। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আরোপ নিয়ে দর কষাকষি সফলতা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তবে গত এক বছরেও ব্যবসা-বাণিজ্যর স্থবিরতা কেটে না উঠা, সাধারণ ব্যবসায়ীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে না আসা সরকারের সীমাবদ্ধতাকেই চিহ্নিত করে। এছাড়া চাঁদাবাজদের দৌরাত্ন্য এবং দু’একজন উপদেষ্টার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডও সরকারের সার্বিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তবে আমাদের মনে রাখা দরকার অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে একের পর এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোসহ প্রশাসনিক পুনর্গঠনে সরকারকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। সরকার গঠনের এক মাসের মাথায় আনসার বিদ্রোহ, শ্রমিক আন্দোলন, বিভিন্ন কলেজের ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন ধরনের উসকানি মোকাবেলায় সরকারকে অনেকটা ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
শুরুতে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী চেতনায় সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য দেখা গেলেও পরবর্তীতে নির্বাচনের সময়ও পদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্য দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা জন্ম দেয়। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতি রাজনৈতিক সংকটকে আরো ঘনীভুত করে। লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়টি একটু দূর হলেও জনমনে পুরোপুরি আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়নি। আমি মনে করি তারেক রহমান যত শীঘ্রই দেশে ফিরবেন ততই তা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
শেখ হাসিনা তার শাসন আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে চেতনা ব্যবসা করে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ে তোলাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। এদিক থেকে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানও বৈষম্যবিরোধী চেতনায় সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশের গণআকাঙ্খাকেই তুলে ধরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য যে মহান স্বপ্নকে সামনে রেখে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অকাতরে জীবন দিল, অনেকেই চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল, সে স্বপ্ন, কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তাই এখন বড় চিন্তার বিষয়। স্বাধীনতা ও জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে প্রথমত, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। আপাতত সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের বিতর্কে না গিয়ে বরং জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়াই যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি। মতৈক্যের ভিত্তিতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে যা ভবিষ্যতে কোনোভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে না পারে। আমাদের মনে রাখা দরকার অন্যায়ের জবাব অন্যায় দিয়ে নয়, বরং বাংলাদেশের মতো বহুত্ববাদী সমাজে সকলের সমান ও ন্যায় অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কথায় কথায় ফ্যাসিবাদ ট্যাগ লাগিয়ে দিয়ে কিংবা ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যায়িত করে নির্দোষ ও নিরীহ কাউকে হয়রানি করা যাবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এতো প্রাণের বিনিময় অর্থবহ ও সত্যিকার অর্থে সফল হয়ে উঠবে তখনই যদি আমরা এমন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি যেখানে সবার জন্য থাকবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার এবং অন্যান্য সর্ব ন্যায়সঙ্গত অধিকার।বাংলাদেশের পোশাক
লেখক- পিএইচডি গবেষক
ওয়েইন স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ
ও সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়