নাজিম সরকার- আগের দিনে পাড়াগাঁয়ে প্রেম মানে ছিল যুবকদের কাছে “টক অব দ্যা ইয়ার”…। সেই যুগে ছিল না ফেসবুক কিংবা ইমো। ছিল না মোবাইল নাম্বার। দিনের পর দিন পছন্দের রমনীর পেছনে ঘুরঘুর করে ছেলেরা মেয়েদের মন জয় করতে চাইতো। বাড়ির নাবালকদের সহযোগিতায় চলতো চিঠি দেয়ার চেষ্ঠা, কখনো সফল হতো কখনোবা ব্যর্থ। এরপরে আসতো দিনের পর দিন চিঠির অপেক্ষা। মাঝে মধ্যে হিতে বিপরীত হয়ে মুরুব্বিদের ধমক শুনে মজনুর প্রেমবিলাশ টুটে যেত। তাই তখন ক্রাশ থেকে প্রেমে পরিনতির পরিমান ছিল ০.০০০১%…। প্রেম চালিয়ে নেয়া ছিল সিন্ধু জয়ের চেয়েও কঠিন।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নোকিয়া কোম্পানীর কল্যানে যুবকদের হাতে হাতে মোবাইল এলো। শুরু হল হন্য হয়ে মেয়েদের নাম্বার খুঁজাখুঁজি। রং নাম্বারে না দেখেই চলতে থাকল প্রেম। বাড়ল পারিবারিক কলহ। মজনুদের প্রেমের ফাঁদে পা দিল শত শত তরুনী। প্রেমের পরিমান গিয়ে ঠেকল ১০% এর বেশী। কেউ রাতের পর রাত কাটাতে লাগল মোবাইল কোম্পানির ডিজুস অফার পেয়ে, কেউ হন্য হয়ে খুঁজতে লাগল কোন মিষ্টি মধুর কণ্ঠের রমনীর নাম্বার।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এলো Migg, Nimbuzz সহ নানা সোশ্যাল মিডিয়া। রং নাম্বারে প্রেম করা যুবকরা এবার রমনীদের খোঁজে নিমবাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেল ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ প্রভৃতি। এখন এই দেশের ৯৫% যুবকের সোশ্যাল মিডিয়া মানেই ফেসবুকে সেলফি দিয়ে লাইক হিসাব করা এবং চ্যাটে সারাদিন ৮-১০টা মেয়েকে ইমপ্রেস করার চেষ্ঠা চালানো। গাড়িতে, বাড়িতে কিংবা আড্ডায় আপনার পাশের যুবকটি ব্যস্ত কোন রমনীকে রিপ্লাই দেয়াতে। একই ছেলে এখন ১৫-২০জন মেয়ের সাথে প্রেম করার কিংবা চ্যাট করার সুযোগ পাচ্ছে।
কিন্তু মেয়েরাও কি কম যায়? তারা রীতিমত একের পর এক ড্যাশিং হিরোকে পাত্তা না দিয়ে, নিজেকে ক্লিওপেট্রা ভাবতে থাকে। একের পর এক সেলফি দিয়ে ছেলেদের মনে আগুন ধরাতে ব্যস্ত তারা।
কিন্তু বিধাতা বানিয়েছেন যাকে বুদ্ধি কম দিয়ে, সেই নারী কি পারে পুরুষদের কাছে কুটকৌশলে জিততে…?? ছেলেদের ছলচাতুরী কিংবা আবেগমিশ্রিত কথাতে একসময় গলে যায় রমনী। শুরু হয় প্রেম। মন দেয়ানেয়ার সাথে নিয়মিত মেসেঞ্জারে চলে সেলফি দেয়ানেয়ার কাজও। আস্তে আস্তে বাড়ে গভীরতা, কমতে থাকে কাপড়ের বাধ্যকতা। যে মেয়েটি একসময় নিজেকে ক্লিওপেট্রা ভাবতো, সেই মেয়েটিও একটি ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু মেয়েটি জানে না, ছেলেটি আরো ১০টা মেয়ের সাথেও প্রেম করে অনলাইন মিডিয়াতে অথবা জানে না এই প্রেমের শেষ পরিণতি কি। প্রেম করা তরুন তরুনীর সংখ্যা এখন ৫০% এর কম হবে না এবং নিয়মিত অন্তত একটি মেয়ের সাথে চ্যাট করে এমন ছেলের সংখ্যা ৯৯% বললে ভুল বলা হবে না। সামজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম মোবাইলে ব্যবহারের কারনে, গোপনীয় থাকে সবকিছু। তাই পরিবারের অন্য সদস্যরাও জানছে না কিছুই।
প্রযুক্তির কল্যানে মেয়েরা এখন স্বপ্ন দেখে নিজের পায়ে দাড়ানোর এবং স্বাবলম্বী হবার। কিন্তু মাঝপথেই থেমে যায় স্বপ্ন। পারিবারিক কারনে বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হয় মেয়েরা। কিন্তু অতীতের চ্যাট হিস্টোরি তো থেকে যায়। সেই চ্যাট হিস্টোরি থেকে জন্ম নেয় পারিবারিক অবিশ্বাস। শুরু হয় দাম্পত্য জীবনের কলহ। যে ছেলেটি বিয়ের আগে অন্তত ৫০টি মেয়ের সাথে নিয়মিত চ্যাটিং করতো, সেই ছেলেও বিয়ের পরে স্ত্রীর বিবাহপূর্ব চ্যাটের জন্য সন্দেহ করতে থাকে। এভাবেই নীরব সামাজিক অবক্ষয় ঘটে চলেছে দেশে। এছাড়াও বাড়ছে বিয়ের পূর্বে গোপনে ধারনকৃত ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে ধর্ষনের ঘটনা। নীরবে সহ্য করে শত শত ভুক্তভোগী মেয়েরা, পরিস্থিতির শিকার মেয়েরা চুপ থাকে সম্মানহানির ভয়ে। নেই কোন ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। বিগত তিন বছরে দেশে ধর্ষন মামলা হয়েছে ১৭হাজার ২৮৯টি। বাস্তবে ঘটনা আরো ভয়াবহ এবং কয়েকগুন বেশি। পুলিশি হয়রানি ও সমাজে মানসম্মান হারানোর ভয়ে অধিকাংশ ধর্ষিতার পরিবার নীরবে সহ্য করতে বাধ্য হয়। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে মেয়েরা। প্রেম অথবা বন্ধুত্বের নামে ছেলেদের সাথে কিংবা সহপাঠীদের সাথে গড়ে উঠছে সুসম্পর্ক। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে সহজেই বাড়ছে সখ্যতা। আস্থার সম্পর্কের কারনে মেয়েরা বিশ্বাস করে পাঠিয়ে দেয় ছবি। একসময়ে দেখা দেয় মনোমালিন্য, এরপর প্রেমের নামে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয় একের পর এক রমনী।
সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের দেশে সুফলের চেয়ে কুফল বয়ে এনেছে বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবসহ অন্যান্য কারনে ২০১৭ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ২হাজার ৬১১টি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। যা ছিল মোট বিবাহের ২৮.৫৪%। ভয়াবহ চিত্র বলা যেতে পারে। ২০০৬ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ছিল দেশে ০.৬%, কিন্তু ২০১৭ সালে বেড়ে দাড়িয়েছে ১.২%। রাজধানীতে ২০১১ সালে বিচ্ছেদের রেকর্ড ছিল ৫হাজার ৩২২টি, মাত্র ৪বছরে চারগুন বেড়ে সেই সংখ্যা ২০১৫ সালে বেড়ে হয় ২২ হাজার ৪৮৮টি। বিচ্ছেদ আবেদনের ৮০% ভাগই ছিল নারীদের দ্বারা। সামান্য অজুহাতে এখন স্বাবলম্বী মেয়েরা বিচ্ছেদের আবেদন করে। বর্তমানে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে আরো ৪৯হাজার বিচ্ছেদ আবেদন। আগের দিনে পুরুষশাসিত সমাজে যৌতুকের কারনে বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি ঘটলেও, এখন উত্তরাঞ্চলে মাদকাশক্তি ও দাম্পত্য কলহ বিচ্ছেদের প্রধান কারন। শহরু সমাজে মাদকাশক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন ও পরকীয়াই বিচ্ছেদের প্রধান কারন। গ্রামাঞ্চলে বিবাহপূর্ব প্রেম বিচ্ছেদের প্রধান কারন।প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পরকীয়া হচ্ছে বিচ্ছেদের প্রধান কারন। আশংকাজনক হারে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। মুল কারন প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, শহরের চেয়ে গ্রামে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বেশি। প্রতিদিন ঢাকা শহরে ১৫টি তালাক ঘটছে। যার ৮৭% ছিল পরকিয়ার জের ধরে। ২০১৬সালে চট্টগ্রামে ৩হাজার ৯৬১টি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, যার ৭০% আবেদন ছিল নারীদের। জার্মানভিত্তিক বাংলা পত্রিকা ডয়েসভেলে ২০০৬ সালে সতর্কবাণী ছাপায় বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে, কিন্তু সরকার কিংবা কোন পক্ষ কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে এক যুগ পরে পরিস্থিতি এখন আরো ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে।
যুবসমাজকে সোশ্যাল মিডিয়ার সঠিক ব্যবহার শেখাতে প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষার প্রসার। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আরো বেশি মাত্রায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ে ধর্মীয়গুরুদের আলোচনা করা উচিত। সরকারের উচিত নারীদের সুরক্ষা প্রদান করা, যেন প্রযুক্তির কল্যানে নারীরা নিরব নির্যাতনের শিকার না হয়।
লেখকঃ প্রকৌশলী ও সহযোগী সম্পাদক
অনলাইন ফেনীর কথা ডট কম