ঢাকা অফিস: এক দশক আগে ডিজিটাল শব্দটা খুব বেশি পরিচিত ছিল না এদেশের মানুষের কাছে। তবে একেবারে অপরিচিত ছিল তাও নয়। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল’ শব্দটার পর জুড়ে দেয়া হলো ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’- এই শব্দ যুগল অন্য এক বার্তা নিয়ে হাজির হলো এদেশের মানুষের কাছে।
অনেকের কাছে বিষয়টা একটু ধোঁয়াশাচ্ছন্নও ছিল। বেশির ভাগ মানুষ এর ব্যাপ্তি, গভীরতা, অর্ন্তনিহিত অর্থ, বাস্তবিক প্রয়োগ সম্পর্কে প্রায় ধারণাহীন এক জগতের বাসিন্দা ছিল। দশ বছরে তাদের সেই ধারণার জগত অনেকটা পাল্টে গেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ এদেশের মানুষের কাছে এখন আর মঙ্গল গ্রহের মত নতুন কোন বিষয় নয়। সেটা শহরের মানুষ থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠ- কম বেশি ধারণা এখন মোটামুটি প্রায় সবার আছে। একটা প্রজন্মের কাছে তাদের স্বপ্নের জগতটাই এখন ডিজিটাল। ডিজিটাল এক জগতেই তাদের বসবাস।
তবে হ্যাঁ, উন্নত পৃথিবীর সংগে তুলনা করতে গেলে আমরা পিছিয়ে অনেক জায়গায়। অন্যরা যখন ফাইভ জি নিয়ে চলে আমরা তখন ফোর জি-র কথা ভাবি। তারপরও বিশাল এই জনগোষ্ঠী উন্নত বিশ্বের সাথে তাল রেখে চলার চেষ্টা করছে, সেটাই বা কম কী! বছর দশেক আগে সেটা ভাবাও যায়নি। তবে আগামীর পৃথিবী এগিয়ে চলেছে অনেক দ্রুত গতিতে। তাদের সাথে তাল রেখে চলতে হলে আমাদের আরো অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজড হওয়া দরকার। কিন্তু সেই লক্ষ্য ছুঁতে আমরা কী খুব একটা ইচ্ছুক?
উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ বোধক বলতে পারছি না। তার দায়টা শুধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের তা নয়। যারা নীতি নির্ধারক কিংবা জনগণকে পথ দেখানো এবং তাঁদের সংগে নিয়ে চলার কথা যাদের, তারা ঠিক চলতে চান না। কিংবা জনগণকে সাথে নিতে অনাগ্রহী। কথাটা শুনতে হয়তো অনেকের ভাল লাগবে না। বা লাগছে না । তবে এটাই অপ্রিয় সত্য।
রাজনীতিবিদের কাজ দেশকে এগিয়ে নেয়া। দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখানো। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। কিন্তু সত্যি-ই কী আমাদের রাজনীতিবিদরা সেই কাজটা খুব আন্তরিকভাবে করছেন। বা করতে চাইছেন? বাস্তবতা বলছে – না।
এক দশক আগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে দলটা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথম ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বললো, তারা একনাগাড়ে দশ বছর ক্ষমতায়। এবার তাদের বলা উচিৎ তারা কতোটা ডিজিটাল করতে পেরেছেন বাংলাদেশকে। আর বাংলাদেশের মানুষকে। কিন্তু তারও আগে প্রশ্ন, তারা মানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতোটা ডিজিটাল হতে পেরেছে?
তাদের নেতারা কতোটা ডিজিটাল। তাদের কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা শুনে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর চিন্তা-ভাবনাকে বাদ দিলে তারা কোন কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেন না। প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো বলে বেড়ানোই তাদের কাজ। প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে তাঁকে বেশি ভাবতে হয় এবং হচ্ছে। কিন্তু তিনি যাদের দল চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন তারা কী ডিজিটালি কোন কিছু করতে পারছেন?
যদি পারতেন, তাহলে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মনোনয়পত্র ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়। সেখানে দলীয় মনোনয়ন বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আবাসিক এলাকার মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। উৎসবের আমেজ দিতে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে লাভ কী!
দল-সরকার তো জনগণের জন্য। মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু সেই মানুষের মনে সামান্য ক্ষোভও একটা আধুনিক চিন্তা ভাবনার ধারক, গণতান্ত্রিক দলের জন্য শুভ কিছু নয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের জন্য শো ডাউন করতে গিয়ে মোহাম্মদপুরে দুই গ্রুপের সংর্ঘষে দুই জনের প্রাণ গেলো। দায় কার?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন; নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনেই। আর নির্বাচন কমিশন খানিকটা জেগে জেগে ঘুমিয়ে থাকার ভাণ করলো। তাদের হাব-ভাব , ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় না, বিষয়টা তারা জানেন।
জনভোগান্তির কথা তাদের মনে পড়লো নয়া পল্টনে বিএনপির মনোনয়ন সংগ্রহের সময় রাস্তায় মিছিল দেখে! বিএনপিকেও শো ডাউন করা থেকে বিরত রাখা যেতো যদি ক্ষমতাসীনরা কাজটা না করতেন। আর সেটা না করার উপায়ও ছিল। আওয়ামী লীগ এদেশে প্রথম ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্লোগান দিয়েছে। বাংলাদেশকে ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগও তারা নিয়েছে। তা হলে নিজেদের দলের কার্যক্রমটাকে ডিজিটালি পরিচালনার উদ্যোগ নিতে এতো দ্বিধা কেন?
ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে অনেকে নাম লেখাবেন এটা স্বাভাবিক। আর এখন আওয়ামী লীগে কর্মীর চেয়ে নেতাও বেশি। তারা সবাই এখন এমপি-মন্ত্রী হতে চান। সুতরাং ত্রিশ হাজার ফরম কিনতে তাদের খুব একটা চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে না। কিন্তু এই মনোনয়ন ফরম বিক্রির কাজটা কী আওয়ামী লীগ ডিজিটালি মানে অনলাইনে করতে পারতো না?
তা হলে এই শো ডাউনের ব্যাপারটা বড় হয়ে সামনে আসতো না। মানুষের ভোগান্তি বাড়তো না। আর টাকাটা অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতেই পারতো। তাতে স্বচ্ছতা আরো বাড়ত। যারা মন্ত্রী-এমপি হতে যান তারাই বা কতোটা ডিজিটাল হয়েছেন গেলো দশ বছরে তারও একটা প্রমাণ মিলতো।
কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো আওয়ামী লীগ নিজেরাই এখনও অ্যানালগ থেকে গেলো। যে কারণে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএম এর ব্যবহার নিয়ে এখনো মানুষের কাছে পরিষ্কার একটা ধারণা তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের কাছে ইভিএম এক ধোঁয়াশার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচনের আগে! কিন্তু এটা হতে পারতো অন্যরকম কিছু।
ডিজিটাল বাংলাদেশকে পরিপূর্ণতা দিতে রাজনৈতিক দলগুলোকেও ডিজিটাল হওয়া দরকার। তাদের কার্যক্রম আরো ডিজিটালি হওয়া উচিৎ। না হলে মানুষ বাস্তবতাকেও শ্লোগান মনে করবে। তার জন্য সাধারণ মানুষকে দোষ দেয়া যাবে না।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।



