ফেনী
মঙ্গলবার, ২১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৪:১৮
, ২৮শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

৫০০ টাকার পুঁজিতে দেশসেরা সফল নারী

দেশ, জাতি ও সমাজ বিনির্মাণে এখন পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে চলেছে নারীরাও। এরই ধারাবাহিকতায় কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায় পারুল আক্তার (৪০) দেশসেরা অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী পদকে ভূষিত হয়েছেন। মাত্র ৫০০ টাকা পুঁজি নিয়ে নার্সারির কাজ করে সংসার চালাতে শুরু করেন তিনি। নিজের দক্ষতা ও মেধা দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি শতাধিক নারী-পুরুষকে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী করে তুলেছেন।

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়- এ প্রবাদবাক্য নিজের জীবনে যেমন বাস্তবায়ন করেছেন, তেমনি অন্যের জীবনের ভাগ্যের চাকাও বদলানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন পারুল আক্তার। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তিনি আজ সফল উদ্যোক্তা।

প্রতিদিন এলাকার যুবক-যুবতীরা পারুল আক্তারের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে আসছেন। তার কর্মকা-ে মুগ্ধ হচ্ছেন সবাই। বাড়ছে তার নার্সারির চারাগাছের চাহিদা। গত ৯ মার্চ জাতীয় পর্যায়ে আত্মনির্ভরশীল নারী দিবসের সেমিনারে কর্মদক্ষতা পর্যবেক্ষণ ও আত্মনির্ভরশীল শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে পারুলকে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ সরকার এবং অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী দেশসেরা স্বীকৃতি ও জাতীয় পদক গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে।

২২ বছর আগে উপজেলার নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের বাখরনগর গ্রামের ইউনুছ মিয়ার মেয়ে পারুল বেগমের বিয়ে হয় একই গ্রামের কাউছার আলমের সঙ্গে। ছোট একটি কুঁড়েঘরে ছিল তার সংসার। বিয়ের দুই বছর পর কোলজুড়ে আসে একটি মেয়েসন্তান। বিয়ের পর স্বামী রিকশা চালাতেন। সংসারে আরও সন্তান আসে। রিকশা চালিয়ে ছেলেমেয়েদের দুবেলা খাওয়ানোর মতো আয় হতো না। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেন পারুল। তাতেও তিন সন্তানসহ পাঁচজনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারতেন না।

পারুল বেগম একসময় পরিকল্পনা করেন নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। আত্মপ্রত্যয়ী পারুল শুরু করেন স্বপ্নের ফুল ফোটাতে। সে জন্য পুঁজি ও কারিগরি শিক্ষা প্রয়োজন। ৫০০ টাকা নিয়ে কিছু ফলের গাছের কলম তৈরি করে বিক্রি করেন। পরে নার্সারি কাজের প্রশিক্ষণ নেন। ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হয় তার নতুন জীবনসংগ্রাম। ’

২০০৪ সালে ‘সবুজ নার্সারী’ নামে ছোট একটি নার্সারির শুরু করেন পারুল। নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করতে তার বুদ্ধি, কর্মদক্ষতা ও মেধা দিয়ে সুদক্ষ হাতে শুরু হয় নার্সারি ব্যবসা। আস্তে আস্তে তার অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। বর্তমানে তিন বিঘা জমি নিয়ে চলছে তার নার্সারী।

এখানে কি পাল, চেরি, মিরাক্কেল, এভিলিও, পাসিমন, মেঙ্গু সিটি, অলিভ, কিউই, আইসক্রিম ড্রিঙ্কস অরেঞ্জ লংগান, এডোকাডের মতো দেশি-বিদেশি শতাধিক জাতের গাছের চারা রয়েছে। নার্সারিতে দৈনিক ১৫ জন লোক কাজ করে।

পারুল বেগমের এখন মাসিক আয় ৭০-৮০ হাজার টাকা। সংসারে নেই আর কোনো অভাব কিংবা সমস্যা। অর্থনৈতিকভাবে সফল পারুল স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসারের কান্ডারি এখন। পাশাপাশি এলাকার শত শত দুঃস্থ লোককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার কাছে কাজ শিখে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেক নারী-পুরুষ।

তবে গল্পটি যত সহজে বলা গেল, বাস্তবতা অতটা মসৃণ ছিল না পারুলের। পারুল আক্তার বলেন,‘নারী হিসেবে ব্যবসা করার বিষয়টি সমাজ খুব সহজভাবে মেনে নেয় না। তাও আবার গ্রামের মতো জায়গা। পরিবার থেকে সে সময় স্বামী আমার পাশে থাকায় আজ এ অবস্থায় আসতে পেরেছি। আমি কয়েক শ নারী-পুরুষকে কাজ শিখিয়েছি। তাদের অনেকে আজ স্বাবলম্বী।

তার অর্জনের প্রতি সরকারের স্বীকৃতি নারীসমাজের মুখ উজ্জ্বল করেছে বলে মনে করেন পারুল আক্তার। তিনি বলেন, ‘সরকার আমার মতো এক নারীকে দেশসেরা পদক দিয়ে নারীসমাজের সম্মান উজ্জ্বল করেছেন।’

পারুল আক্তার শুধু নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত নন, স্বপ্ন দেখেন অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানোর। তিনি বলেন, দসংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। বাকি জীবনটাও সংগ্রাম করে কাটিয়ে দেব অসহায়দের পাশে থেকে।’

সংসারের সুখ-শান্তি অর্জনের সব তৃতিত্ব পারলকে দেন স্বামী আবু কাউছার। বলেন, ‘আমি স্বামী হিসেবে সংসারের দায়িত্ব নিতে পারিনি। আমার স্ত্রী পারুল নিজের কর্মদক্ষতায় আত্মনির্ভরশীল নারী হিসেবে দেশ ও এলাকার মান উজ্জ্বল করেছে।’ এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

মুরাদনগর উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যান ড. আহসানুল আলম সরকার কিশোর বলেন, ‘সবুজ নার্সারির মাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যুবক-যুবতীদের এনে আত্মনির্ভরশীল করতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুবসমাজ স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি নিজের ও দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। পারুল আক্তার নারীসমাজকে জাগ্রত এবং মুরাদনগর উপজেলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন।’

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo
error: Content is protected !!