ফেনী
মঙ্গলবার, ২১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৪:২০
, ২৮শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

করোনা ভীতি কাজে লাগিয়ে রমরমা ব্যবসা,দ্বিগুণ মূল্যে মিলছে মাদক

একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, তা হলো ‘গায়ে-বাছুরে (গাভি ও বাচ্চা গরু) মিল থাকলে দুধের অভাব হয় না।’ তাই যেন ফুটে উঠেছে মাদক চক্রের তৎপরতায়। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের আতঙ্কে যখন অধিকাংশ মানুষ চরম আতঙ্কে সময় পার করছেন, সেখানে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মাঝেই নানা কৌশলে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে মাদক চক্র। বরং করোনা ভীতিকে কাজে লাগিয়েই চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা। চিহ্নিত স্পট বা লাইসেন্সধারী বার আপাতদৃষ্টিতে বন্ধ থাকলেও দালাল বা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে অনায়াসেই চলছে মাদক কেনাবেচা। অবশ্য এ জন্য মাদকসেবীদের গুনতে হচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ টাকা। তবে টাকা যাই লাগুক এসব কৌশলে মিলেমিশে চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা। বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা কর্মকর্তাসহ একাধিক মাদকসেবীর সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, কেবল র‌্যাবের অভিযানেই গত প্রায় দুই মাসে সারা দেশে ৮৮০ মাদক কারবারি গ্রেফতার করা হয়েছে। কেবল ইয়াবা ট্যাবলেটই উদ্ধার করা হয়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৩৯২ পিস।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মদের বার কিংবা মাদকের নির্দিষ্ট স্পটগুলো বন্ধ থাকলেও মোবাইল ফোনে এক শ্রেণির মধ্যস্থতাকারী বা ‘মাদক দালালরা’ দেশি-বিদেশি মদসহ নানা মাদকদ্রব্য পৌঁছে দিচ্ছে বাসাবাড়িতে। অবশ্য এর জন্য গুনতে হচ্ছে বেশ বাড়তি টাকা। কেননা, করোনার কারণে প্রতিটি মাদকেরই দাম হাঁকানো হচ্ছে দ্বিগুণ হারে। মাদকসেবীরাও দামকে পাত্তা দিচ্ছে না। বরং যেকোনো উপায়ে কাক্সিক্ষত মাদক পেতে চালিয়ে যাচ্ছে নানা প্রচেষ্টা।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি সকল ব্র্যান্ডের মদ হাতে পেতে গুনতে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ বাড়তি টাকা। মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের মাঝখানে মধ্যস্থতাকারী দালালরা পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দিচ্ছে। এ জন্য তাকেও দিতে হচ্ছে মোটা বকশিশ।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপ-পরিচালক মেজর হুসেইন রইসুল আজম মনি বলেন, করোনার কারণে প্রায় সবকিছু বন্ধ থাকার সুযোগে এক শেণির মাদক কারবারিরা আরও বেশি টাকা কামনোর লক্ষ্যে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সে, তরকারির গাড়িতে, নৌপরিবহনসহ নানা মাধ্যমে কৌশল খাটিয়ে এসব মাদক চোরাচালান আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে সতর্ক আছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সফল অভিযান পরিচালিত হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অবস্থান সব সময় জিরো টলারেন্স নীতিতে চলবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৫ এপ্রিল বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটর ফুটওভার ব্রিজের পশ্চিম পাশের গোড়ায় বসে দুজন মাদকসেবি গাঁজা সেবন করছিল। পরিচয় গোপন করে আলাপচারিতা শুরু করলে তারা জানায়, একজনের বাড়ি শরীয়তপুরে এবং অপরজনের বাড়ি ফরিদপুরে। তারা এ এলাকায় ফুটপাতে থাকে আর ‘ধান্দা’ করে চলে বলে সাফ জানায়। তবে কী ধরনের ধান্দা তা জানতে চাইলে বলে, যখন যা সামনে আসে। এ সময় লম্বা চুল ও কালচে বরন চেহারার মাদকসেবী তার হাতে থাকা কাগজের ওপরে রাখা কিছু পরিমাণ গাঁজা দেখিয়ে বললেন, ‘আর বলকেন না। খাওয়ার মধ্যে এই গাঞ্জাটুকুই খাই, তার দামও দ্বিগুণ হইছে। আগে এইটুকু কিনতাম ১০০ টাকায়, এখন এইডা কিনতে হচ্ছে ২০০ টাকায়। বাবার (ইয়াবা) দামও দ্বিগুণ হইছে।’

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, কেবল গাঁজা বা ইয়াবা নয়, করোনার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও সব ধরনের দেশি-বিদেশি মাদকদ্রব্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে।
তথ্যমতে, সকল ডিলাক্স ড্রিঙ্কস যেমন ব্ল্যাক লেভেল, শিভাস রিগাল প্রতি বোতল বিক্রি হতো সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায়, করোনাকালে এখন তা বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকায়। যা করোনার আগের স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ হাজার টাকা বেশি। নরমাল হুইস্কি যেমন পাসপোর্ট, গ্র্যান্ড, হান্ড্রেড পাইপারস,  ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট আগের মূল্যের চেয়ে গড়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশিতে কেনাবেচা চলছে। ভদকা এবং জিন ৩ হজার থেকে বেড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি কেরু ভদকা এবং হুইস্কি ১ হাজার ৪৫০ থেকে বেড়ে ১৭ থেকে ১৮শ টাকায়, কেরু জিন ১৭শ থেকে ২৩ থেকে ২৪শ টাকায় এবং ভদকা লিথুনিয়ান, বাঁকাডি, স্পিনঅফ ৩ হাজার থেকে বেড়ে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। অপরদিকে ট্যাক্স ফ্রি এম্পরিয়ার অর্থাৎ বিদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য যেসব মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হয় সেগুলোও দালালদের মাধ্যমে ভিন্ন কিছু পন্থায় মাদকসেবীরা জোগাড় করছে বলে জানা গেছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, যেখানে করোনার কারণে সকল ধরনের বার বন্ধ, রাস্তাঘাটে যানবাহনও চলছে সীমিত, সেখানে এই মাদক কারবারিদের নিত্যনতুন কৌশল বিস্মিত করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে।

র‌্যাব সদর দফতরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক এএসপি সুজয় কুমার সরকার  জানান, করোনার ভয়াবহতার মাঝেও মাদকচক্র তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। গত ৮ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে র‌্যাবের অভিযানে মাদক কারবারের সাথে জড়িত ৮৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই সময়ে উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৩৯২ পিস ইয়াবা, ৬ কেজি ২৫৫ গ্রাম হেরোইন, ১৫ হাজার ৪১৭ বোতল ফেনসিডিল, ৯৫৪ কেজি ৮৫৫ গ্রাম গাঁজা, ১৯ হাজার ৫ লিটার দেশি মদ এবং ১ হাজার ৩২৭ ক্যান বিয়ার।

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo
error: Content is protected !!