চলতি বছরের ৬ এপ্রিল। আলিম পরীক্ষা চলছিল ওই সময়ে। সেদিন সকালে বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে নিয়ে মাদ্রাসায় কেন্দ্রে আলিম আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে যান নুসরাত জাহান রাফী। গেটে নামিয়েই নোমান মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যান। রাফী পরীক্ষা হলে যান। সেখানে বসতে না বসতেই সহপাঠি উম্মে সুলতানা পপি ওরফে চম্পা ওরফে শম্পা রাফীকে জানান যেÑ তার বান্ধবী নিশাতকে কারা যেন ছাদে মারধর করছে। সহজ সরল রাফী তার কথা বিশ্বাস কওে মাদ্রাসার তৃতীয় তলার ছাদে গেলে সেখানে বোরকা পরা ও হাতে মোজা পরিহিত চার মুখোশধারী রাফীকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানীর চেষ্টার মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।
এসময় তারা রাফীকে বলে, মামলা তুলে না নিলে তাকে মেরে ফেলা হবে। এরপরও রাফী মামলা তুলে নেয়ার প্রস্তাব ও হুমকি প্র্যাখ্যান করেন। আর তখনই ওই চারজনের মধ্যে মুখোশধারী সহপাঠি কামরুন নাহার মনি রাফীর দুই হাত পেছনের দিকে ওরনা দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপরই শাহাদাত হোসেন শামীম শক্তকরে রাফীকে চেপে ধরে। কেরোসিন ঢালে জাভেদ। আর তখনই রাফীর শরীওে আগুন ধরিয়ে দেয় যোবায়ের। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকেন রাফী। তৃতীয় তলার ছাদে এমন একটি বর্বরতার সময় রাফীর চিৎকার সেভাবে নিচে পৌছায়নি। এদিকে নিচে ও গেটসহ বিভিন্ন পয়েন্টেও মোতায়েন ছিল নুর উদ্দিন, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মোহাম্মদ শামীমসহ বেশ কয়েকজন। আগুনে পুড়তে পুড়তে এক পর্যায়ে হাতের বাঁধনও পুড়ে খুলে যায়। ওই অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে একাকী সিঁড়ি দিয়ে সামান্য নিচে নামতে পারেন রাফী। এরপরই জ্ঞ্যান হারিয়ে পড়ে যান। এ সময় আশপাশের লোকেরাও টের পেয়ে যায়। তাৎক্ষণিক পরীক্ষা সেন্টারের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য, পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকরা রাফীকে উদ্ধার করে স্বজনদের জানিয়ে দ্রæত সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়। এরপর ফেনী সদর হাসপাতাল হয়ে ওই দিন বিকেলেই রাফীকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। গুটি কয়েক গণমাধ্যম ও স্থানীয় পুলিশ প্রথমে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করলেও খুব অল্প সময়ে প্রকৃত ঘটনা সারাদেশে জানাজানি হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়ে ফেনী, সোনাগাজীসহ সারাদেশের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সরাসরি রাফীর এই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসার সার্বিক তদারকি করেন। ঢামেক হাসপাতালে টানা চারদিন ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ভোগ করে অবশেষে ১০ এপ্রিল রাতে না ফেরার দেশে চলে যান নুসরাত জাহান রাফী। রাফীর এই মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকাÐের প্রতিবাদে সারাদেশে সোচ্চার হয়ে উঠে। থানা পুলিশের পর তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। পিবিআইয়ের তদন্তেই বেরিয়ে প্রকৃত ঘটনা। কিভাবে কতটা নির্মমভাবে একটি মেয়েকে হত্যা করা হয়েছিল তার একটি স্কেচ বা সচিত্র প্রতিবেদনও তৈরি করে পিবিআই।
জানা যায়, এর আগে ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ২৭ মার্চ। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিলল মাদ্রাসা। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা পিয়ন নুরুল আমিনকে দিয়ে আলিম শ্রেণীর (পরীক্ষার্থী) নুসরাত জাহান রাফীকে তার রুমে ডেকে নেন। তখন আরও তিন-চারজন বান্ধবীকে নিয়ে অধ্যক্ষের রুমে রাফী ঢুকতে চাইলে শুধু তাকে ঢুকতে দেন পিয়ন। এরপর দরজা আটকে দিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ রাফীকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে শ্লীলতাহানীর চেষ্টা চালান। রাফী বাধা দিয়ে চিৎকার দেয়ার হুমকি দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে সিরাজ বাধ্য হয় তাকে ছেড়ে দিতে। এরপর সিরাজের বিরুদ্ধে রাফীকে শ্লীলতাহানীর মামলা করেন তার মা শিরিন আক্তার। সেই মামলায় কাল হয় রাফীর। ঘটনা জানাজানি হলে স্থানীয় জনতার চাপে পুলিশ বাধ্য হয় অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেফতারে। কিন্তু তাতে কী। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বসেই অনুসারীদের নির্দেশ দেন রাফীকে হত্যার। সেই অনুসারেই পরে আগুনে পুড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় সাহসী কন্যা রাফীকে। যে আলোচিত হত্যা মামলায় গতকাল অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ।