২০১৩ সালের কথা। সবারই হয়তো মনে আছে।দেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর একটি দিন ছিল ওই বছরের ৫ মে। আজ সেই ৫ মে। সেদিন রাজধানীর মতিঝিল-পল্টন রণক্ষেত্রে পরিণত করেছিল ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, মুহুর্মুহু গুলি, গুলতি, টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়েছিল রাজধানী। বিভীষিকাময় এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাতের অভিযানে অন্তত ১১ জন নিহত হন বলে জানানো হয়। হেফাজতের তান্ডবের ঘটনায় রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ওই সময় মামলা হয় অন্তত ৭০টি। তবে দীর্ঘ এই সাত বছরেও মামলাগুলোর তেমন সুরাহা হয়নি। অধিকাংশ মামলাই ‘ডিপ ফ্রিজে’ রয়ে গেছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের এই দিনে রাজধানী ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বর ও পল্টন এলাকা অবরোধ করে ব্যাপক তান্ডব চালায় হেফাজতের কর্মীরা। দলে দলে ঢাকায় আসার পথেও দেশের কয়েকটি স্থানে সহিংসতা ঘটায় তারা।এদিন হেফাজতের তান্ডবে ভস্মীভূত হয় মতিঝিল, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকার ৫ হাজারেরও বেশি দোকান, বিভিন্ন ভবন, ব্যাংক, একাধিক ব্যাংকের এটিএম বুথ, সরকারি গাড়ি, বাস, মোটরসাইকেল, পিকআপসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। এমনকি বায়তুল মোকাররম ঘিরে গড়ে তোলা ফুটপাথের দোকানগুলোর হাজার হাজার বই ও পবিত্র কোরআন-হাদিসেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। কেটে ফেলা হয়েছিল রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনকারী শত শত গাছ। রাস্তার মাঝদ্বীপ ভেঙে বিভিন্ন দোকান ও ভবনে আগুন দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ভুতুড়ে শহরে পরিণত করা হয় রাজধানীর ওই এলাকাগুলো। তবে সকাল থেকে দিনব্যাপী ভয়াবহ পরিস্থিতির অবসান ঘটানো হয় গভীর রাতে। বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ ছিলেন ওই সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার। বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাবের যৌথ অপারেশনে মতিঝিল-পল্টন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় হেফাজত কর্মীরা। অবশ্য এই অভিযানে হেফাজত কর্মী, সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্য মিলে মোট ১১ জন নিহত হয় বলে পুলিশ জানায়। যদিও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলেও দাবি করেছিল হেফাজত ও একটি মানবাধিকার সংগঠন। তবে যৌক্তিক প্রমাণ দিতে তারা ব্যর্থ হয়।
জানা যায়, ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচির নামে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় হেফাজত কর্মীরা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এসব ঘটনায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ সারা দেশে ৭০টি মামলা হয়। তবে ওই ঘটনায় করা মামলা তদন্তে তেমন কোনো গতি নেই বলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ কর্তৃক ইসলাম অবমাননা প্রশ্নে হেফাজতে ইসলাম মাঠে নামে। এরপরই সংগঠনটি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে মাঠে নামে। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম ঢাকামুখী লংমার্চ কর্মসূচি দিয়ে তারা আলোচনায় আসে। এরপরই ৫ মে ঢাকা ঘেরাও এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি দেয় সংগঠনটি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, হেফাজতের তান্ডবের মামলাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোরই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সেগুলো বিচারাধীন আছে। বাকিগুলোরও দ্রুত চার্জশিট দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
জানা যায়, ওই দিনের ঘটনায় দায়ের রাজধানীর ৫৩টি মামলার মধ্যে রমনা থানায় ৩টি, শাহবাগ থানায় ৪টি, কলাবাগান থানায় ২টি, শেরেবাংলা নগর থানায় ১টি, মতিঝিল থানায় ৬টি, পল্টন থানায় ৩৩টি, রামপুরা থানায় ১টি ও যাত্রাবাড়ী থানায় ৩টি মামলা হয়। রাজধানীতে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে রমনা থানার ১টি, শাহবাগ থানার ১টি ও কলাবাগান থানার ২টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ঢাকার সব মামলাতেই হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে প্রধান আসামি করা হয়। এছাড়া ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী এবং যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের মামলার আসামি করা হয়। তবে কোনো মামলাতেই হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে আসামি করা হয়নি।