ঢাকা অফিস: বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন পর্যন্ত দুই কোটি মানুষ আর্সেনিকযুক্ত দূষিত পানি পান করছেন। দেশে খাওয়ার পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ার দুই যুগ পরও সরকার এ সমস্যার প্রতিকারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে।
বর্তমানে দেশের ৪২টি জেলার প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০ বছরে আর্সেনিক দূষণের কারণে প্রতি ১৮ জনে ১ জনের মৃত্যু ঘটবে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানান, নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের অন্যতম ছিল আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানির সংস্থান করা। এরপর প্রায় ১০ বছর অতিবাহিত হতে চললেও এখনও নিশ্চিত হয়নি দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পান করা পানির মাধ্যমে শরীরে আর্সেনিক প্রবেশ করলে তা বের করা কষ্টসাধ্য। আর্সেনিকের কারণে শরীরে যে পরিবর্তন ঘটে, তা কোনোভাবেই আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। ফলে সাধারণত বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষেত্রবিশেষ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় ত্বক। এসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
জানা গেছে, ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে মানুষের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। আড়াইহাজারে করা এ গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে সাধারণ রোগে গড়ে মৃত্যুঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে ২৪ শতাংশ।
দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুহার বৃদ্ধিতে আর্সেনিকের সম্পৃক্ততার ব্যাপারটি ইতঃপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, আর্জেন্টিনা, তাইওয়ান এবং বাংলাদেশের মতলবে করা বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গেছে। প্রতি লিটার পানিতে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক পান করার ফলে ক্রনিক ডিজিজ যেমন- ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়বেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুঝুঁকি ৬৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এই দাবি করেছে।
‘নেপোটিজম অ্যান্ড পনগলেক্ট : দ্য পাইলিং রেসপন্স টু আর্সেনিক ইন দ্য ড্রিংকিং ওয়াটার অব বাংলাদেশ’স রুরাল পুওর’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ জানায়, বাংলাদেশের আর্সেনিক সংক্রান্ত অসুস্থতায় প্রতিবছর প্রায় ৪৩ হাজার মানুষ মারা যায়।
আর্সেনিকের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা তৈরি হয়। প্রতিবেদনের লেখক ও এইচআরডব্লিউ’র জ্যেষ্ঠ গবেষক রিচার্ড পিয়ার্সহাউজ বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের খাওয়ার পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করার জন্য মৌলিক ও জরুরি পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে না।
সরকারের আচরণ এমন যে, সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০০৪ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আর্সেনিক দূষণের শিকার এলাকাগুলোয় প্রায় ১৩ হাজার টিউবওয়েল বসানো হয়। সেগুলো সঠিক জায়গায় বসানো হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে তদন্তের আহ্বান জানায় এইচআরডব্লিউ।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০০৩ সালে করা এক জরিপে সারা দেশে ২৭১টি উপজেলায় ৫০ লাখ নলকূপে আর্সেনিক পরীক্ষা করে জনস্বাস্থ্য সংস্থাটি। যার মধ্যে ২৯ ভাগ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও দেশের অবশিষ্ট উপজেলাগুলোর নলকূপ পরীক্ষা করা হয়নি।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে যে ১২ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তা মোকাবেলায় সরকার ১ হাজার ৯৬৬ কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ফলে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (এনসিডিসি) ডা. নূর মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, আর্সেনিক প্রসঙ্গে দাতাসংস্থার পক্ষ থেকে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি সঠিক নয়। আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। সম্প্রতি অধিদফতরের পক্ষ থেকে কয়েকটি উপজেলায় সার্ভে করা হয়েছে।
অল্পদিনের মধ্যে সে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবীর যুগান্তরকে বলেন, ভুগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।



