মশাবাহিত যেসব রোগ রয়েছে তার মধ্যে এত দিন আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল ম্যালেরিয়া। সেই যুদ্ধে আমরা অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছি, প্রকোপ অনেকটাই কমেছে। এখন দেখা দিয়েছে আরেক শঙ্কা, যার নাম ডেঙ্গু। এটিও মশাবাহিত রোগ।
২০০০ সালের মোটামুটি প্রথম দিক থেকেই এ রোগের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। গেল বছরের আগ পর্যন্ত এটি নিয়ে আমরা তেমন একটা দুশ্চিন্তা করিনি। কারণ এটি অন্য অনেক ভাইরাল জ্বরের মতোই লক্ষণ দেখায়। বরং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, এমনকি তাদের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার যোশ চোপড়া এই রোগে মারা যান। অনেক চেষ্টা চলছে এটি প্রতিরোধের জন্য। সম্ভব হচ্ছে না।
Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-এর এক হিসাব অনুযায়ী ২০৮০ সালের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পৃথিবীজুড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১.৫ থেকে ৩.৫ বিলিয়ন। এর কারণ হলো উষ্ণতা বৃদ্ধি। তাপমাত্রা পৃথিবীজুড়ে বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের ৭০ শতাংশ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশও এর মধ্যে পড়েছে। যত খরা, তত ডেঙ্গুর ঝুঁকি। এর কারণ এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক, এই মশার জীবনচক্র থেকে দেখা যায় আবহাওয়া যত উষ্ণ হবে তার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দিন তত কম হবে। ফলে এটি খুব দ্রুত রোগ ছড়াতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের কী করা প্রয়োজন? ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা—সবারই ডেঙ্গু প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে।
১. সামাজিক দায়
বৃষ্টি হলে, কোথাও পানি জমে থাকলে এই মশা সহজে বিস্তার লাভ করে। অপরদিকে ভারি বর্ষণ হলে সব ডিম ধুয়ে চলে যায়। প্রকৃতির ওপর আমাদের হাত নেই, তবে গাছ লাগিয়ে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা আমরা করতেই পারি। এতে উষ্ণতা যেমন কমে, সেই সঙ্গে বাড়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা। সরকারি সহযোগিতা বা অবদানের দিকে না তাকিয়ে আমরা আমাদের বাসার আশপাশ এবং এলাকার যেখানে পানি জমে আছে তা পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে পারি। পানিপ্রবাহের রাস্তায় পানির সঞ্চালন বাড়িয়ে দিতে পারি, যাতে ডিম পরিপূর্ণতা না পায়।
২. পারিবারিক দায়িত্ব
মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টায় সারাক্ষণ মনোযোগ থাকলে সব কাজই বিঘ্নিত হয়। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক জীবন। সারাক্ষণ মশারির ভেতর অবস্থান করা সম্ভব নয়। তাই মশা যাতে বাইরে থেকে চলাচল না করতে পারে তার দিকেই মনোযোগ দিলে সমাধান হয়তো একটু সহজ। ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সাধারণত এডিস মশা দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে না। তাই রুমের তাপমাত্রা এমন রাখার চেষ্টা করলে ফল ভালো পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বারান্দায় গাছ লাগানো যায় আবহাওয়া ঠিক রাখার চেষ্টাস্বরূপ, তবে খেয়াল রাখা দরকার তাতে পানি জমে থাকছে কি না।
৩. সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দায়িত্ব
অপর্যাপ্ত জনবল দিয়ে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আসলেই দুরূহ কাজ। তাই জনগণের সচেতনা বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগী হওয়া বেশি জরুরি। নিজস্ব জনবলকেও দক্ষ করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মশা নিধনের ওষুধ আবদ্ধ নর্দমায় ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, দিন শেষে কেমিক্যাল খরচ হয়েছে মর্মে শান্তি মিললেও ভালো ফল মিলছে না। ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মাঝে নিজের আপনজনও থাকতে পারে, এই মনোভাব নিয়ে কাজ করলে হয়তো কার্যক্রম আরো সফল হবে। নর্দমা পরিষ্কার করে সেটি আবার তার পাশেই জমিয়ে রাখা হয়, যেটি বেলা শেষে সেই নর্দমাতেই চলে যায়। তাই কাজের সমন্বয় প্রয়োজন।
কেমন হতে পারে রোগের লক্ষণ?
অন্য অনেক ভাইরাস রোগের মতো এর লক্ষণও একই রকম থাকে—গায়ে জ্বর, মাথা ব্যথা হওয়া, মাংসপেশিতে ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, খাওয়ার ব্যাপারে অবসাদ হওয়া, দুর্বল লাগা ইত্যাদি। তাই এসব লক্ষণ দেখা দিলে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ার চেয়ে ন্যূনতম এমবিবিএস চিকিত্সককে দেখানো উচিত। ভুলেও ব্যথা কমার ওষুধ সেবন করা উচিত নয় নিশ্চিত না হয়ে।
গেল বছর পর্যন্ত এসব লক্ষণই ছিল মূলত আমাদের দেশের রোগীদের মাঝে। ডেঙ্গু রোগের চার ধরনের সেরোটাইপ রয়েছে—
DENV-১, ২, ৩ এবং ৪। একবার একটি হলে তার বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায় (অ্যান্টিবডি)। পরে আরেকটি সেরোটাইপ দিয়ে হওয়ার ঝুঁকি কিন্তু থেকেই যায়, লক্ষণ প্রায় একই থাকলেও ঝুঁকি বেড়ে যায়। আবার কোনো সময়ে অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও তা থাকে অপর্যাপ্ত, ফলে নতুন সেরোটাইপ দিয়ে হলে তাদের মধ্যে ক্রসলিংক হওয়ার কারণে পরিণাম হয় মারাত্মক। এখন যেমনটি দেখা যাচ্ছে। জ্বর ছাড়াও শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, প্রেসার কমে যাচ্ছে, রোগী শকে চলে যায় দ্রুত। অবহেলার সুযোগ নেই। তাই কতগুলো বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। ১. আগের চেয়ে শরীর বেশি অবসাদ লাগছে কি না। ২. আগের চেয়ে কম সময় দাঁড়িয়ে থেকেও কি ক্লান্তি লাগছে? ৩. তীব্র ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিচ্ছে কি না। ৪. স্বাভাবিকের চেয়ে প্রস্রাব কম হচ্ছে কি না। ৫. সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব হওয়া। ৬. শরীরের নানা জয়েন্ট ফোলা ভাব আসা। ৭. পেটে পানি আসার লক্ষণ দেখা। ৮. চোখের সাদা অংশে রক্তক্ষরণের মতো দৃশ্যমান হওয়া। ৯. অচেতন লাগা ইত্যাদি।
এসব লক্ষণ দেখা গেলে দেরি না করে নিকটবর্তী হাসপাতালে যোগাযোগ করা। সরকারি হাসপাতাল সব ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত। কারণ সব সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকে।
রক্ষা পেতে হলে যা করতে হবে
১. দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস কমানো।
২. ছোট বাচ্চাদের দিকে নজর রাখা, মোজা পরিয়ে রাখা, সম্ভব হলে তার ব্যবস্থা করা।
৩. ছোট-বড় সবাই প্রচুর পানি পান করা স্বাভাবিকের চেয়ে।
৪. মশারি টানিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করা।
৫. ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা।
৬. মশা নিয়ন্ত্রণের ওষুধের সচেতন ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রভৃতি।
মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু এরই মধ্যে রাজধানীতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এই রোগ প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক : ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ