ফেনী
শনিবার, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৮:০০
, ১৪ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

৯ আসামীকে কারাগারে প্রেরণ

সোনাগাজীতে শিক্ষার্থীকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় ৪ আসামীর রিমান্ড মঞ্জুর

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গত শনিবার সকালে আরবী ১ম পর্ব বিষয়ে আলিম পরীক্ষা শুরুর ১৫ মিনিট পূর্বে নুসরাত জাহান রাফিকে ফুসলিয়ে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয় চার মুখোশধারী। এ সময় রাফি অস্বীকৃতি জানালে মুখোশধারীরা হত্যার উদ্দেশ্যে তার গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায়। তখন অগ্নিদগ্ধ ওই ছাত্রীর চিৎকার শুনে পরীক্ষা কেন্দ্রে কর্তব্যরত পুলিশ ও মাদরাসার কর্মচারীরা এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে। তাৎক্ষণিক তাকে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। অবস্থা গুরুতর দেখে সেখান থেকে তাকে ফেনী আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রেরণ করলে তার গুরুতর অবস্থা দেখে ওইদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে প্রেরণ করা হয়। সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকলেও সোমবার দুপুর থেকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হলে তার উন্নত চিকিৎসায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিঙ্গাপুর প্রেরণের নির্দেশ দিলেও রাফির শারীরিক অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে নেয়া হয়নি। ফলে মঙ্গলবার রাফির অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে বলে তার পরিবার সূত্রে জানা গেছে।

ন্যাক্কারজনক ঘটনা-পরিদর্শনকালে ডিআইজি
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে ফেনীতে আসেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি বুধবার দুপুরে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি অত্যান্ত দু:খ জনক ও ন্যাক্কারজনক। আমি রাফির সুস্থতা কামনা করি। ঘটনায় জড়িতদের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাই। বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত করতে পোশাকে ও সাদা পোশাকে তদন্ত চলছে এবং এ ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করতে সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ইশারা ইঙ্গিতে ঘটনাটি আত্মহত্যা বুঝাচ্ছেন। অথচ ঘটনাটিকে আপনি (ডিআইজি) ন্যাক্কারজনক বলেছেন বলে এর প্রকৃত কারণ জানতে চান এক সাংবাদিক। জবাবে ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, তদন্ত শেষে বলা যাবে প্রকৃত ঘটনাটি কি। এর আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

এর আগে রবিবার পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি আবুল ফয়েজের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। মাদ্রাসার ১১ জন শিক্ষার্থী, দুই শিক্ষক ও পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের জবানবন্দি নিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেছেন, নুসরাতের অগ্নিকা-ের ঘটনাটি আগের ঘটনার জেরে আত্মহত্যার চেষ্টা বা হত্যার চেষ্টা হতে পারে। দুটি বিষয় মাথায় রেখেই ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে।

মামলার আসামী সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি
নৃশংস এ ঘটনায় সোমবার বিকালে শিক্ষার্থীর ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান সোনাগাজী মডেল থানায় বাদি হয়ে অজ্ঞাত ৪ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়েছে মর্মে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও রাতে আরেকটি এজাহারে ৮জনকে আসামী করা হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়। এটি নিয়ে এত বিভ্রান্তি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে ফেনীর পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানান, মামলার এজাহার নেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। এটি স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় তা দ্রুত দিতে গিয়ে ভুলক্রমে ৪ কে আসামী করা হলেও হলেও পরে তা ঠিক করে ৮ জনকে আসামী করা হয়েছে।
আসামীরা হলেন, সোনাগাজী পৌর কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা, প্রভাষক আবছার উদ্দিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নুর উদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের।

৯ আসামীকে কারাগারে প্রেরণ
এদিকে ঘটনা তদন্তে সোনাগাজী মডেল থানার পাশাপাশি জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম মাঠে কাজ করে যাচ্ছে। তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ফেনী শহরের সদর হাসপাতাল এলাকা থেকে সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মাদরাসার নিরাপত্তা প্রহরী মো. মোস্তফা, মাদরাসা থেকে অফিস সহকারী ও অধ্যক্ষের ফুফা শ্বশুর নুরুল আমিনকে আটক করে। এছাড়া আলাউদ্দিন, নুর হোসেন প্রকাশ হোনা মিয়া ও শহীদুল ইসলাম নামের তিনজনকে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয়। আর ওইদিন সোমবার রাতে কুমিল্লা থেকে কেফায়েত উল্লাহ নামের আরেকজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এদেরকে বুধবার বিকালে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরন করা হয়। এর আগে ঘটনার দিন আটককৃত মাদ্রাসার প্রভাষক আবছার উদ্দিন ও আলিম পরীক্ষার্থী আরিফুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মঙ্গলবার বিকালে ৫৪ দারায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে প্রেরন করেছেন পুলিশ।
এদিকে এঘটনায় এজহার নামীয় আসামী কারাবন্দি অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ও মাদ্রাসার প্রভাষক আবছার উদ্দিনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।

৪ আসামীর ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর
এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আলাউদ্দিন, নুর হোসেন হোনা মিয়া, কেফায়েত উল্লাহ ও শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৪ (১) ৩০ ধারা মোতাবেক ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক কামাল হোসেন। বুধবার বিকালে চীপজুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালতের বিচারক শরাফ উদ্দিন তাদের ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন।

অধ্যক্ষের শালিকার মেয়ে আটক
আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় সোমবার বিকালে মৃত্যুশয্যায় দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, নেকাব, বোরকা, হাতমোজা পরিহিত চারজন তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই চারজনের একজনের নাম ছিল শম্পা। পুলিশ এই সূত্র ধরে শম্পাকে গ্রেফতার করতে বিভিন্নস্থানে অভিযান চালায়। পরে অধ্যক্ষ সিরাজের শালিকার মেয়ে আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা (১৮) কে শম্পা সন্দেহে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টার দিকে উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রাম থেকে আটক করে থানায় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে বলে পুলিশ সূত্র জানায়। সুলতানা ওই এলাকার শহিদুল ইসলামের মেয়ে। সে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ৯নং হল থেকে আলিম পরীক্ষা দিচ্ছে।

শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন
মাদ্রাসা ছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টাকারীদের শাস্তির দাবীতে মঙ্গলবার সকালে ফেনীতে কর্মজীবী নারী’রা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন ফেনী জেলা জাসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কাজী আবদুল বারী ও কর্মজীবী নারী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেত্রী রোকেয়া সুলতানা আঞ্জু।

প্রসঙ্গত: ১৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।পরে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অধ্যক্ষের মুক্তির দাবীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে। অন্যদিকে আরেকটি পক্ষ অধ্যক্ষের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন পালন করেন।

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo
error: Content is protected !!