ফেনী
মঙ্গলবার, ২১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ১০:৪৮
, ২৮শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

উন্নয়নের সুফল পায়নি গরিব মানুষ

বিশেষ প্রতিনিধি- নির্বাচনের বছরে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় রক্ষণশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এ সময় জনতুষ্টিমূলক সম্প্রসারণশীল নীতি গ্রহণে সরকার প্রলুব্ধ হতে পারে। অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য যা উচিত হবে না। আগামী কয়েক মাস সংরক্ষণমূলক নীতিতে থাকা সরকারের জন্য শ্রেয় হবে।

শনিবার চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনায় সিপিডি এসব কথা বলেছে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে সামগ্রিক অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাত, রোহিঙ্গা ও বন্যার বিষয়টি নিয়ে বিশেষ আলোচনা করা হয়। সিপিডির পক্ষে পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। উপস্থাপনা শেষে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন সংস্থাটির সম্মাননীয় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।

পর্যালোচনায় বলা হয়, ২০১৭ সাল বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটানোর যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয়েছিল, শেষটা তেমনভাবে হয়নি। প্রবৃদ্ধির হার রক্ষা করতে পারলেও কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমেছে। আয়, সম্পদ ও ভোগে বৈষম্য বেড়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ঋণ ও পুঁজি পণ্যের আমদানি বাড়লেও তা উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দুর্বল হয়েছে; চাপের মধ্যে পড়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এসব হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংস্কারমূলক মনমানসিকতার অভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্বলতা ছিল। এদিকে, বর্তমানে আমদানি ও মূল্যস্ম্ফীতি বৃদ্ধি, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, সংস্কারের অভাব, রফতানি ও রেমিট্যান্স আয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি না থাকায় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা চাপের মুখে পড়েছে।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকার দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। এ সময়ে সাধারণত জনতুষ্টির প্রকল্প বাড়বে। বাড়বে থোক বরাদ্দও। এতে খরচ অনেক বেড়ে যেতে পারে। আবার নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষ সংস্কার সরকার করতে পারবে না। কারণ, সংস্কারের মতো রাজনৈতিক পুঁজি নেই। তিনি বলেন, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকারকে সংরক্ষণমূলক স্থিতিশীল নীতি নিতে হবে। ঋণের প্রবাহ কমাতে হবে। টাকার মান কমিয়ে আমদানি কমানো এবং রফতানি ও রেমিট্যান্স উৎসাহিত করা যেতে পারে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। মূল্যস্ম্ফীতি কমাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বেশি ঘাটতি না হয়। ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়া, বড় বড় প্রকল্পের ভেতর থেকে বিভিন্ন ধরনের ঠিকাদারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থ ভিন্ন খাতে নেওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্বাচনের বছরে সংস্কারের উদ্যোগ থাকে না। ফলে সংস্কারের অভাবে যে দুর্বলতা, তা থাকবে। যা অর্থনীতির জন্য বাড়তি ঝুঁকি। চলতি হিসাবের ভারসাম্যে নেতিবাচক অবস্থা বাড়ছে। খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতি বেড়েছে। এসব কারণে সতর্ক হতে হবে, যে কারণে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা হতে হবে সংযত।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে অনেক দেশই পিছিয়ে পড়েছে। সে বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতি বাড়লে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ম্ফীতিও বাড়ে। কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যান তা বলছে না। এদিকে মজুরি যা বেড়েছে, তাতে কোনোমতে মূল্যস্ম্ফীতি মেটানো যাচ্ছে। ফলে মজুির বৃদ্ধি হলেও তা কোনো কাজে লাগছে না।

চ্যালেঞ্জ :দেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ দেখছে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে প্রবৃদ্ধি হলেও দারিদ্র্য কমার হার কমেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রবৃদ্ধির যে কার্যকারিতা, তা নেই। বাড়ছে বৈষম্য। এটি অর্থনীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ। রাজস্ব আয়ের দুর্বলতা আরেকটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে সিপিডি বলছে, আয়করের দুর্বলতা কমানো যায়নি। আমদানি রাজস্ব-নির্ভরতা বেড়েছে। এ দুর্বলতা কাটাতে রাজস্ব আয়ের নতুন ক্ষেত্র বের করা এবং ফাঁকি ও অপচয় কমানোর পরামর্শ এসেছে সংস্থাটি থেকে। উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতির চাপও অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ। কারণ মূল্যস্ম্ফীতি যা হচ্ছে, তার সঙ্গে সমন্বয় করে সব খাতের মানুষের মজুরি বাড়ছে না। মজুরি যতটা বাড়ছে, তা কোনোমতে মূল্যস্ম্ফীতিকে সামাল দেওয়ার মতো। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। এ ছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতিও মাথাব্যথার কারণ। ফারমার্স ব্যাংকসহ বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক পুরো ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি তৈরি করেছে। সবশেষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে লেনদেনের ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা রক্ষা করাকে দেখছে। এরই মধ্যে আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু তার বিপরীতে রফতানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়েনি।

ব্যাংক খাত :সিপিডি বলছে, সদ্য-সমাপ্ত বছরে ব্যাংকিং খাতে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি প্রকাশ পেয়েছে। খেলাপি ও অপরিশোধিত ঋণ বাড়ছে। অদক্ষতাও বেড়েছে। সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ের অভাব স্পষ্ট হয়েছে। ফারমার্সসহ অন্যান্য নতুন ব্যাংকের অবস্থা ভালো নয়। শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে এমন হচ্ছে বলে মনে করছেন সিপিডির গবেষকরা। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে। সরকার নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর পরিবর্তে মূলধন জোগান ও পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক আধিপত্য বাড়ানোর মতো উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে, যা উদ্বেগের। এ রকম অবস্থায় নতুন করে আর কোনো লাইসেন্স না দিয়ে ব্যাংক মার্জার (একীভূতকরণ) করার বিষয়ে সরকারের ভাবা উচিত। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০১৭ সালকে ব্যাংক খাতের জন্য কেলেঙ্কারির বছর হিসেবে উল্লেখ করেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। চলতি বছরও ব্যাংক খাতের ঘটনাগুলোর কোনো নিরসন হবে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি দিয়ে বোঝা যায়, সংস্কারের বিষয়ে সরকারের মনোভাব কী রকম ছিল।

তুলা আমদানির প্রবৃদ্ধিতে সন্দেহ :মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বস্ত্র খাতে সম্প্রসারণ বিশেষ কিছু হয়নি। রফতানিও বিশেষ বাড়েনি। আন্তর্জাতিক বাজারদর, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষ পরিবর্তন নেই। সে অবস্থায় তুলা আমদানিতে ৭৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি অবশ্যই খতিয়ে দেখার বিষয়।

রোহিঙ্গা ইস্যু :সিপিডি বলছে, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে ৭৪১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে যে পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবস্থান করছে, তাতে দৈনিক ৩০০ জন করে ফেরত গেলে সাত বছর লাগবে। এ সময়ে অবস্থান নেওয়া জনগোষ্ঠীর জন্য ৮০০ কোটি ডলার লাগবে। আর ফেরত যাওয়ার হার কম হলে বা সময় বেশি লাগলে খরচ আরও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চাপ তৈরি হবে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্বসম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি।

বৈষম্য বাড়ছে :২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে মানুষের আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। ২০১৬ সালে দেশের মানুষের মোট আয়ের শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ আসে সবচেয়ে দরিদ্রদের ৫ ভাগ থেকে, যা ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে মোট আয়ে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের অবদান ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ ছিল বলে সিপিডির হিসাব। অর্থাৎ ধনীরা ২০১০ সালে যা আয় করতেন, ২০১৬ সালে এসে এর চেয়ে বেশি আয় করছেন, অন্যদিকে আয় কমেছে গরিবদের। তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে প্রবৃদ্ধির সুফল পৌঁছায়নি। গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে।

অন্যান্য আলোচনা :সুদহার কমলেও তার সুফল ছোট উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন না। প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যতটা সুবিধা নিতে পেরেছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সক্ষমতার সবটা কাজে লাগাতে পারেনি। তৈরি পোশাক খাতে পণ্যমূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে দরকষাকষির সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রার পাশাপাশি ভারত, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মুদ্রার বিপরীতেও বাংলাদেশের টাকা দুর্বল হয়েছে। ফলে প্রতিযোগীদের তুলনায় রফতানি সক্ষমতা বেড়েছে।

বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়েছে। বেড়েছে কঠিন শর্তের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও। বিদেশি এসব ঋণের সুদহার দেশের বাজারের ঋণের সুদহারের সমান বা বেশি। আর্থিক ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo
error: Content is protected !!