আফরোজা পারভীন-প্রচণ্ড শীত লাগছে। ঘরের ভেতর দু-দুটো মোটা সোয়েটার চাপিয়েও ঠক ঠক করে কাঁপছে। সেন্ট্রাল হিটিং কি ঠিকমতো কাজ করছে না? কে জানে। এতক্ষণ দুটো সোয়েটার আর গলায় মাফলার জড়িয়ে দুটো ভারী কম্বলের মাঝে জড়োসড়ো হয়েছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে থাকার সুযোগ নেই। কব্জি উল্টে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। ট্রেনের মাত্র আধঘণ্টা বাকি। অবশ্য স্টেশন যাকে ইটালিয়ানরা বলে ‘ম্যাসরে ভিসেনসিয়া’ অর্থাৎ ভিসেনসিয়ার রেলস্টেশন সেটা খুব দূরে নয়। কিন্তু গোছানোও তো কিছু হয়নি। দ্রুত বিছানা ছাড়ে রাজিয়া। ছেড়েই প্রবল শীতে আক্রান্ত হয়। পায়ে পায়ে বাড়ি লেগে ঠক ঠক করে। সেই কাঁপুনি নিয়েই জানালার শার্সি সামান্য খুলে আবারো আঁতকে ওঠে। পেজা তুলোর মতো বরফ আকাশ থেকে নামছে আর নামছে। দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রাজিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করে সামনের রাস্তায় দাঁড় করানো গাড়িটা দেখতে। দেখতে পায় না। এতক্ষণে নিশ্চয়ই গাড়ির ছাদে একহাত বরফ জড়ো হয়েছে। ওই বরফ না সরাতে পারলে গাড়ি বের করা যাবে না। আর রাস্তারই বা কী অবস্থা কে জানে। স্টেশন অবধি পৌঁছানো যাবে তো। না পৌঁছাতে পারলে সর্বনাশ। এই ট্রেনে ভিয়েনা পৌঁছতে পারলেই যে দেশে যাওয়ার বিমান ধরতে পারবে। ভিয়েনা থেকে টিকিট কনফার্ম করা হয়ে গেছে। বড় দিনের এই ব্যস্ততম সময়ে অনেক কষ্টে ট্রেন আর বিমানের টিকিট পাওয়া গেছে। একই কারণে পাওয়া যায়নি রোমের টিকিট। ইটালিতে এসে রোম দেখতে না পারার কষ্ট নিয়েই ফিরে যাচ্ছে রাজিয়া। তার ওপরে এই বিপর্যয়। ট্রেনে কোনো অল্প দামের টিকিট পাওয়া যায়নি। টিকিট পাওয়া গিয়েছিল দাঁড়ানো আর কেবিনে। দাঁড়ানো টিকিট শুনে অবাক হয়েছিল রাজিয়া। দাঁড়িয়ে গেলে কম পয়সায় যাওয়া যেত, কিন্তু রাজিয়া যে দেশের মেয়ে সে দেশের মানুষ দরিদ্র হলেও আয়েশী। দাঁড়িয়ে এতগুলো ঘণ্টা রাতের বেলা যাওয়ার কথা তারা ভাবতেও পারে না। তার ওপরে রাজিয়া একজন মেয়ে।
রাজিয়া কেবিনের টিকিট নিতে বলেছিল। ফয়সল টিকিট কেটে আনলে রাজিয়া জিজ্ঞেস করেছিল।
: এ দেশের ট্রেনের কেবিন কেমন?
: টু সিটেড। খুব আরামদায়ক। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারবেন।
: তা তো পারবো বুঝলাম। কিন্তু যদি কোনো পু…
এ পর্যন্ত বলে থেমে যায় রাজিয়া। ফয়সলের সাথে তার সম্পর্ক খালা-ভাগ্নের। তার মনে যে আশঙ্কার উদয় হয়েছে তা ভাগ্নেকে বলা শোভন নয়। কিন্তু মনে মনে প্রচণ্ড আতঙ্ক হয় রাজিয়ার। বিদেশ বিভুঁয়ে যদি কোনো বিদেশী পুরুষ একা কেবিনে সারা রাতের ভ্রমণে তার সফরসঙ্গী হয় তবে কী উপায় হবে!
রাজিয়ার বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু নিজেকে এখনো সে আশঙ্কামুক্ত মনে করে না। সারা জীবন পুরুষের হ্যাংলামো দেখেছে সে। তার চোখে পুরুষ মানেই বিভীষিকা। একে এই আতঙ্কের মধ্যে আছে তার ওপরে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিভ্রাট। প্রচণ্ড ভয়ে দৌড়ে দরজার কাছে যায় রাজিয়া। কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ মানে না। তীব্র স্বরে ডাকে।
: ফয়সল ফয়সল।
সে ডাকে ভয় এতটাই ছিল যে, ফয়সলও দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
: কী হয়েছে আন্টি?
: বাইরে তাকিয়ে দেখ, প্রচণ্ড বরফ পড়ছে। তোমার গাড়ি নিশ্চয়ই বরফের নিচে ঢাকা পড়েছে। রাস্তাঘাটেও নিশ্চয়ই বরফ জমে পাহাড় হয়েছে। ট্রেনের আছে মাত্র এক ঘণ্টা। কী করে স্টেশনে যাবো?
ফয়সল হাসে। তার মুক্তো সাদা দাঁতগুলো চক চক করে ওঠে। ভাবনার বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখা যায় না চেহারায়।
: ভাববেন না আন্টি। তৈরি হয়ে নিন। সময়মতো পৌঁছে যাবো।
: কিন্তু।
: কোনো কিন্তু নেই। গাড়ি পরিষ্কার করতে মিনিট দশেক লাগবে। গাড়ি তো ভাবনার বিষয় নয়। তার আগে পরিষ্কার করতে হবে ঘরের দরজা থেকে গাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাটুকু।
: তাহলে। এ তো দেখছি বিপদ যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি।
: কিচ্ছু বিপদ না। আমরা যারা বরফের দেশে থাকি তারা বরফের সাথে লড়ার জিনিসপত্র সাথেই রাখি। আর রাস্তায় এক দিক দিয়ে বরফ জমছে আর এক দিক দিয়ে পরিষ্কার করছে। বরফের একটা টুকরোও দেখবেন না রাস্তায়। এ আমার বাংলাদেশ নয় আন্টি।
ফয়সল যা বলেছিল ঠিক তাই ঘটল। অনর্গল কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছিল ফয়সল। শেষ মুহূর্তেও তার চেষ্টা ছিল রাজিয়াকে ভিসেনসিয়া শহরটা চেনানোর। স্টেশনের সামনে এসে বলল
: এই যে পার্কটা দেখছেন আন্টি এটার নাম কাম্পোমারচো। এখন পার্কের কোনো গাছে পাতা নেই। শীতকালে সব পাতা ঝরে যায়। গরমে পাতা বোঝাই হয়ে অপরূপ রূপ নেয় বাগানটা। আগস্টে কাম্পোমারচোতে এক-দেড় মাস ধরে মেলা হয়। চরকি ঘূর্ণিতে শিশুরা দোল খায়। রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত শিশুরা খেলা করে। টিকিট ৯৯ ইউরো।
রাজিয়া তাকিয়ে দেখে কি দেখে না। তার মাথায় কিছুই ঢোকে না। যদিও সময়ের অনেক আগেই তারা স্টেশনে পৌঁছায়। কিন্তু এক বিপদের আশঙ্কা কাটিয়ে অন্য আশঙ্কা তাকে গ্রাস করে। ট্রেনে কী ঘটবে কে জানে! গাড়ি থেকে নেমে স্টেশনে ঢুকতে যে দু-এক মিনিট সময় লাগে তাতেই ওভারকোট ছেয়ে যায় বরফকুচিতে। কাপড়ের জুতোটা ঢেকে যায়। ফয়সল একটা ছাতা মাথার ওপরে ধরেছিল। তাতেই এই। ছাতার রঙ এখন পুরোটাই সাদা। প্লাটফর্মে মাথার ওপর ছাউনি থাকলেও চারধার থেকে বরফকণা ছুটে এসে প্লাটফর্মের মেঝে ঢেকে ফেলেছিল অনেক আগেই। এখন বরফের ওপর বরফ পড়ছে। বেশ পুরু হয়ে গেছে বরফের স্তর। সময়ের আগেই এসে যায় ‘ইউরো স্টার ট্রেন’। প্লাটফর্মে হাতেগোনা দু’চারজন যাত্রী। সবাই বরফের স্তর মাড়িয়ে ছুটছে নির্ধারিত কামরার কাছাকাছি পৌঁছার জন্য। রাজিয়ার ছুটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কাপড়ের জুতো ক্রমাগত পিছলে যাচ্ছে। বরফের কুচি আর জল ভরে জব জব করছে। তীরের মতো বরফ ছুটে এসে লাগছে নাকে মুখে চোখে। দৌড়ে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে সে। লাগেজ দুটোই ফয়সলের হাতে। তার পরও রাজিয়ার শম্বুকগতি। দৌড়ে অনভ্যস্ততা তো আছেই। সাথে আছে প্রতিকূল প্রকৃতি। ট্রেন সামান্য সেøা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ফয়সল পেছন ফিরে চেঁচিয়ে বলে
: আন্টি। ট্রেন মাত্র দু’চার মিনিট দাঁড়াবে। রিস্ক নেবেন না। পাশের কামরায় উঠে পড়–ন।
: কিন্তু কেবিন যদি দূরে থাকে?
: অসুবিধা নেই, টিটি দেখিয়ে দেবে। বাতাস কেটে কেটে বরফ কেটে কেটে কথাগুলো ভেসে আসে। রাজিয়া দ্রুত পাশের কামরার হ্যান্ডেল চেপে ধরে। ও ওপরে উঠতে না উঠতেই লাগেজ দুটো তুলে দেয় ফয়সল। আর সাথে সাথে চলতে শুরু করে ট্রেন। জানালায় ছুটে গিয়ে ফয়সলের দিকে হাত নাড়ার আগেই একটা পিলারে ঢাকা পড়ে ওর মুখ। রাজিয়ার মনে হয় আবছা যেন শুনতে পায় ফয়সলের কণ্ঠস্বর।
: বাই আন্টি।
দুটো লাগেজ নিয়ে রাজিয়ার এখন প্রাণান্ত। সামনে এগোবে না পেছনে যাবে বুঝতে পারে না সে। তখনই নিঃশব্দে আবির্ভাব ঘটে টিটির। টিটি মুখে কিছু বলে না ইঙ্গিতে সামনে এগোনোর নির্দেশ করে হাঁটতে শুরু করে। আর সামান্যক্ষণের মধ্যেই দুই কামরার মাঝখানের দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়। দরজা অবধি পৌঁছতে ঘেমে যায় রাজিয়া। চলন্ত ট্রেনে দুটো লাগেজ টেনে নেয়া সহজ নয়। বারবার হাত থেকে ছুটে যায় লাগেজ। ট্রলিটা সময়মতো বিট্রে করে। ওটাকে যতই সামনে ঠেলতে চায় ততই উল্টে যায়। কান্না পায় রাজিয়ার। টিটিকে দেখতে না পেয়ে সে অসহায় বোধ করে। দরজার কাছে পৌঁছে এক হাত দিয়ে দরজা খুলতে তার প্রাণ বেরিয়ে যায়। দরজার এপাশে এসেও টিটিকে পায় না। আন্দাজে জীবনপাত করে গোটা ছয়েক কামরা পার হওয়ার পর সে টিটিকে ফিরে আসতে দেখে। রাজিয়া বলে
: হোয়ার ইজ মাই কেবিন, হাউ ফার?
টিটি এবারও কথা বলে না। হাঁটতে থাকে। সরু প্যাসেজ দিয়ে দুটো লাগেজ টেনে নিতে গলদঘর্ম রাজিয়ার কানে হঠাৎ আছড়ে পড়ে।
: আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ?
: ইয়েস আই অ্যাম।
রাজিয়া পাশের কামরার দরজা দিয়ে তাকিয়ে টাইট জিন্স আর টপস পরা এক মহিলাকে দেখে। মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে আসে।
: দিন দিন আমার কাছে। আপনি অভ্যস্ত নন তো তাই কষ্ট হচ্ছে। আমাদের এখন এসব সয়ে গেছে। আপনার কেবিন নাম্বার কত।
রাজিয়া টিকিট মহিলার হাতে ধরিয়ে দেয়।
: দেখুন না, খুঁজে পাচ্ছি না। টিটিও কিছু বলছে না।
: এই তো সামনেই আপনার কেবিন। চলুন দিয়ে আসি। আমি পাশেই আছি। কোনো অসুবিধা হলে বলবেন। টিটি সম্ভবত ফ্রেঞ্চ। তাই কথা বলছে না। ওরা পারতপক্ষে ইংরেজি বলে না। এটা ওদের জাতিগত অহমিকা।
টিটি একটা কামরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা রাজিয়াকে নিয়ে সেই কামরার সামনে দাঁড়ায়। বলে
: এটাই আপনার কেবিন। আমি যাচ্ছি। প্রয়োজনে ডাকবেন।
রাজিয়া কেবিনে ঢুকে কাউকে দেখতে না পেয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে। এভাবে ভিয়েনা পর্যন্ত যেতে পারলে সর্বরক্ষা। সে লাগেজ গুছিয়ে ওভারকোট হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে হালকা একটা সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে সিটে লম্বা হয়ে চোখ বোজে। দরজাটা আটকাতে ভোলে না।
কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিল রাজিয়া। ঘুম আসা স্বাভাবিক। এ ট্রেনে হইহল্লা নেই, চেন টানার বিড়ম্বনা নেই। নির্ধারিত গন্তব্যের উদ্দেশে এরা ছুটে চলে বিরতিহীন। তাই ঘুমেও ছেদ পড়ে না। কিন্তু পড়ল। দরজায় টুক টুক আওয়াজ। চোখ মেলেই রাজিয়া বুঝল ট্রেন থেমেছে। হুড়মুড় করে উঠে পড়ল রাজিয়া। কে টোকা মারছে দরজায়? টিটি নয় তো? দরজা খুলে রাজিয়া হাঁ। ভয় পেতেও ভুলে গেল সে। জমে গেল। দরজা খুলে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইল। দীর্ঘদেহী, লাল মুলোর মতো লাল রঙ, একগাদা লাগেজসহ এক পুরুষ দাঁড়িয়ে। আকর্ণবিস্তীর্ণ হাসি ছড়িয়ে একটি অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করল সে। সম্ভবত ‘হ্যালো’ বলল। রাজিয়ার মুখে কোনো কথা সরল না। যুবক বারবার রাজিয়াকে পথ ছেড়ে দিতে ইঙ্গিত করছে। সম্বিত ফিরে পেয়ে রাজিয়া ধপ করে সিটে বসল। যুবক লাগেজগুলো ওপরে তুলে গুছিয়ে বসে রাজিয়ার দিকে তাকালো।
: ডু ইউ নো ফ্রেঞ্চ?
: নো।
: আই অ্যাম মিঁতারো ফ্রম ফ্রান্স। হু আর ইউ কামিং ফ্রম?
: বাংলাদেশ।
: ইজ ইট ইন ইন্ডিয়া?
: নো ইটস এ ইনডিপেনডেন্ট কান্ট্রি। উই ওন আওয়ার ফ্রিডম অন সিক্সটিন ডিসেম্বর নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান ফ্রম দি দেন পাকিস্তান।
: আইসি।
যুবক গল্প করতে শুরু করে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়। জানতে চায় তাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। রাজিয়া ব্যথিত হয় এই ভেবে যে, বিদেশীরা অনেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। অনেকেই মনে করে বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার অংশ। যুবক তাকে যে প্রশ্ন করেছে বিদেশে অনেকবার তাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যুবক গল্প করছে। রাজিয়া চাইছে ও গল্পই করুক। গল্পে গল্পে যেন শেষ হয়ে যায় সারাটা রাত। অন্য কোনো চিন্তা যেন যুবকের মনে না আসে। যুবককে উৎসাহিত করার জন্য রাজিয়া বলেছে, প্যারিস সম্পর্কে সে ভীষণ উৎসাহী। এখানে বিশ্ববিখ্যাত লুভর মিউজিয়াম আছে। যেখানে আছে দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত ছবি মোনালিসা। সে প্যারিস সম্পর্কে আরো জানতে আগ্রহী। যুবক ক্ষণকাল চুপ করে থাকে তারপর বলে
: ইউ ডোন্ট নো ফ্রেঞ্চ। দ্যাট ইজ এ প্রবলেম ফর মে। আই অ্যাম নট এগার টু স্পিক ইংলিশ। ইট ইজ আওয়ার কালচারাল প্রাইড। ডু ইউ নো নেপোলিয়ান টোল্ড ‘ইংলিংশ আর এ রেস অব শপ কিপার’।
: আই নো। বাট আই এম সরি। আই উইল বি এভার
গ্রেটফুল ইফ ইউ স্পিক ইন ইংলিশ।
যুবক হতাশভাবে তাকায় তারপর বলতে শুরু করে। বোঝা যায় নিতান্তই অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজিয়ার অনুরোধে বলছে সে। সে বলে সিস্টিন চ্যাপেলের কথা। যেখানে আছে মিকেল অ্যাঞ্জেলোর পেইন্টিং। বলে আইফেল টাওয়ারের কথা। যে টাওয়ারের ভেতরে রয়েছে একটা রেস্টুরেন্ট। ‘ডিনের মাগনি’ নামের রেস্টুরেন্টটি দেড় শ’ বছরের পুরনো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিতেন মোঁপাসা, ফ্লোবিয়ার্টের মতো বিশ্ববিখ্যাত লেখকরা। ফ্রেঞ্চ একাডেমি রয়াল সোসাইটির থেকেও পুরনো। বলে প্যারিসের বাড়িগুলো দোতলা, খুব সুন্দর। আর ফ্রান্সে বর্ণবিদ্বেষ সবচেয়ে কম। এখানে প্রচুর মুসলিম আছে। আছে আলজিরিয়ান, আফ্রিকান, লিবিয়ান মুসলিম। বলে ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নেতা লাকায়েফের কথা রাজিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। যুবক থামলে রাজিয়া বলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, একুশে ফেব্রুয়ারি, কক্সবাজার, সুন্দরবন, রাঙ্গামটি, শালবন বিহার, এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আদিবাসীদের সম্পর্কে। যুবক কোনো প্রশ্ন না করে শোনে। তারপর ঘড়ির দিকে তাকায়। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। কম্বল গায়ে টেনে দিয়ে বলে
: প্লিজ সুইচ অফ দি লাইট।
কেঁপে ওঠে রাজিয়া, অন্ধকারে কী ঘটবে কে জানে। পুরুষকে কোনো বিশ্বাস নেই। তারপর এ লোক বিদেশী। বিপদে পড়লে তাকে বাঁচাবারও কেউ নেই। অন্ধকার মানেই ভয়, আলোতে তবু মানুষের গতিবিধি বোঝা যায়। তার ওপর কামরায় ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। রাজিয়া ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে যেতে যুবককে বলে, সে অন্ধকারে ভীষণ ভয় পায়। যদি বাতিটা জ্বালানো থাকে তার কি কোনো সমস্যা হবে? যুবক মুখে নো বললেও দু-এক মিনিট যেতে না যেতেই নিজেই উঠে সুইচ অফ করে দেয়। কামরা ছেয়ে যায় গভীর অন্ধকারে। ভয়ের হাজার একটা পোকা জেঁকে ধরে রাজিয়াকে। ও দ্রুত উঠে দরজা খুলে দেয়। অন্ধকারের মধ্যেই যুবকের কণ্ঠ ভেসে আসে
: ডোন্ট ওপেন দ্য ডোর, ইটস টু কোল্ড।
কথা বলে নিবৃত হয় না যুবক। নিজে উঠে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। এবার আধশোয়া থেকে উঠে বসে রাজিয়া। ও লোকের মতলব খারাপ। তা না হলে আলোই বা বন্ধ করবে কেন, দরজাই বা বন্ধ করবে কেন? রাজিয়ার ভীষণ কান্না পায়। তার সন্তানরা বড় হয়ে গেছে। এই বিদেশ বিভুঁয়ে সে কি শেষ পর্যন্ত হবে নির্যাতনের শিকার। রাজিয়ার মনে পড়ে ও তখন সবে কিশোরী থেকে যুবতী হচ্ছে। খুব ভূতের ভয় ছিল তার। দোতলায় একলা ঘরে পড়তে পারত না সে। জানালার পাশেই বিশাল বিশাল গাছ, মা মেয়েকে পাহারা দেয়ার জন্য পাঠাতেন আপন বোনের ছেলেকে। তা রাজিয়ার সেই খালাতো ভাই একদিন ভর সন্ধ্যায় জাপটে ধরেছিল রাজিয়াকে। সে দিন চিৎকার না করলে নির্ঘাৎ একটা মারাত্মক বিপদ ঘটে যেত। ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় রাজিয়ার। এখন যদি ওই যুবক রাজিয়াকে আক্রমণ করে হাজার গলা ফাটালেও কেউ শুনতে পাবে না। রাজিয়া চোখ বড় করে ওপাশের যুবকের দিকে তাকায়। ততক্ষণে অন্ধকার চোখে কিছুটা সয়ে এসেছে। যুবক নিষ্পন্দ। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। রাজিয়া খানিকটা আশ্বস্ত হতে হতে আবার নিজের অবস্থানে ফিরে যায়। কে জানি সত্যি সত্যি ঘুমিয়েছে কি না, নাকি মটকা মেরে পড়ে আছে? কে জানে এটা ওর ভান কি না। কাজেই ঘুমানো চলবে না রাজিয়ার। রাজিয়া অন্ধকারে চোখ মেলে বসে থাকে। যুবকের সামান্য নড়াচড়ায় সে সতর্ক হয়ে ওঠে। যুবক পাশ ফিরে শোয়। ট্রেন এগিয়ে চলে, সময়ও এগিয়ে চলে। আচমকা উঠে বসে যুবক। বাতি জ্বালায়। অবাক দৃষ্টি নিয়ে রাজিয়ার দিকে তাকায়।
: ইউ আর স্টিল সিটিং। হোয়াই?
জবাবে তড়বড় করে অনেক মিথ্যা কথা বলে রাজিয়া। সে ঘুমিয়েছিল, গভীর ঘুম। এই তো সবে উঠল। যুবক হাসল। উঠে বাথরুমে গেল। বাথরুম থেকে ফিরে রাজিয়ার অনুমতি নিয়ে সিগারেট ধরাল। রাজিয়া চাইল ওকে গল্পে মাতিয়ে রাখতে। ‘আমার হাসবেন্ড চেন স্মোকার। কাজেই কোনো অসুবিধা নেই’ বলে হাসল রাজিয়া। যুবক জিজ্ঞেস করল রাজিয়া স্মোক করে কি না। রাজিয়া না সূচক উত্তর দিয়ে ওর বউ ছেলেমেয়ে সম্পর্কে জানতে চাইল। রাজিয়ার সব জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে যুবক রাজিয়ার স্বামী-সন্তানদের সম্পর্কে জানতে চাইল। রাজিয়া সবিস্তারে বলতে শুরু করল। কে জানে ভিয়েনা কত দূর, অনেকক্ষণ তো চলেছে ট্রেন। এই গল্পের মাঝেই যেন এসে পড়ে ভিয়েনা কিন্তু ইচ্ছে পূরণ হলো না। কথা এক সময় শেষ হয়ে গেল। এবার যুবকের চোখে রীতিমতো বিস্ময়। সে বিস্ময় ছুঁয়ে গেল যুবকের কণ্ঠকেও।
: ইওর সান ইজ এ স্টুডেন্ট অব ইউনিভার্সিটি। হাউ ইট ইজ পসেবল? ইউ আর স্টিল ইয়াং অ্যান্ড চামিং।
একযোগে রাজিয়ার সব স্নায়ু সজাগ হয়ে ওঠে। আর রক্ষা নেই। তূণ ছুড়ে দিয়েছে ভিনদেশী। এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। শরীরের সবটুকু শক্তি গলায় ঢেলে বলতে গেলে চেঁচিয়ে রাজিয়া বলে
: আই অ্যাম এ এজেড ওম্যান। আই অলরেডি ক্রসড ফিফটি।
: ইমপসিবল।
কথা শেষ করে মুচকি মুচকি হাসে যুবক। রাজিয়া নিশ্চিত, হাতে আর সময় নেই। ও দৌড়ে বেরিয়ে যায়। বাথরুমে কাটায় অনেক, অনেকক্ষণ। রাজিয়া নিশ্চিত শৈশব কৈশোর যৌবন বার্ধক্য কোনো বয়সেই নিরাপদ নয় নারী। এই তো দিন কয়েক আগে তার এক কলিগ হুট করে টেলিফোনে প্রস্তাব দিয়ে বসল। সুতরাং এই বিদেশী ঘুমিয়ে নিয়ে এখন রীতিমতো তৃপ্ত। সামনে রাতের অনেকটা বাকি। কিন্তু রাজিয়ার সর্বনাশ হতে আর বাকি নেই। সুতরাং যতটা সময় বাথরুমে কাটানো যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু ইচ্ছে পূরণ হয় না। বাথরুমে টোকা পড়ছে। বেরিয়ে আসে রাজিয়া। প্যাসেজে দাঁড়ায়। কিন্তু অসম্ভব। কনকনে ঠাণ্ডা ধেয়ে আসছে। একবার ইচ্ছে হচ্ছে সদ্য পরিচিত সেই বাঙালি মহিলাকে ডাকতে। কিন্তু এত রাতে মহিলা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছেন। সাথে তার স্বামী আছে। মহিলা যদি জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার কী সমস্যা?’ কী জবাব দেবে রাজিয়া? কী করে বলবে ওই বিদেশী যুবককে সে ভয় পাচ্ছে। অসম্ভব। শীতে রাজিয়ার হাত পা জমে গেছে। এখানে কিছুক্ষণ থাকলে শীতেই মারা যাবে সে। সুতরাং কেবিনে ঢোকে। ঢুকে অবাক হয়। কম্বলে মাথা মুখ ঢেকে শুয়ে পড়েছে যুবক। বাতিটা নেভায়নি। সম্ভবত রাজিয়া বাইরে বলে, কিন্তু ঘরে ঢোকামাত্র যুবক বলে
: প্লিজ সুইচ অফ দি লাইট।
রাজিয়া জানে সে বাতি না নেভালে যুবক উঠে নিভিয়ে দেবে। সুতরাং নিভিয়ে দেয়। রাজিয়ার মনে হয় আত্মরক্ষার জন্য প্রতিটি নারীর সাথে একটা অস্ত্র থাকা দরকার। ছোট একটা ছুরি থাকলেও চলত। কিচ্ছু নেই। কী হবে এখন? রাজিয়া বসে বসে আক্রান্ত হওয়ার প্রহর গুনতে গুনতে ভয়ে আধমরা হয়ে যায়। সে কাঁদে কিন্তু সে কান্নার শব্দ শোনা যায় না। একসময় ভাগ্যের ওপর নিজেকে ছেড়ে দেয়। আর ভাগ্যের ওপর সমর্পিত তার স্নায়ুগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায়। কিন্তু ধড়মড় করে উঠে বসে দরজায় টোকার শব্দে। কে টোকা দিচ্ছে দরজায়। যুবকের মাথা ঢাকা তখনো কম্বলে। রাজিয়া দরজা খোলে। টিটি দাঁড়িয়ে। হাতে দু কাপ কফি আর দুটো কেক। তার মানে সকাল হয়েছে।
: ইজ ইট ব্রেকফাস্ট?
টিটি জবাব দেয় না। মাথা নাড়ে। কথার শব্দে উঠে পড়ে যুবক। হাত বাড়িয়ে কফি কেক নেয়। মুখে হাসি। রাজিয়া জানালা তুলে বাইরে তাকিয়ে দেখে সকালের আলো ফুটেছে। ও স্বস্তির দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে। যুবক তাকায়।
: ইউ আর রিয়েলি কমফরটেবল নাউ আই থিঙ্ক।
রাজিয়ার মুখে লজ্জা জড়ানো হাসি ফুটে ওঠে। যুবক কি তার ভাবনাগুলো বুঝে ফেলেছে? এ মন্তব্যের অর্থ কী?
ভিয়েনা স্টেশনে ট্রেন থামে। যুবক প্রথমে রাজিয়ার লাগেজগুলো নামাতে সাহায্য করে। তারপর নিচে নামে। হাতে কাঁধে পিঠে অনেক লাগেজ নিয়ে ও হাঁটতে শুরু করে। রাজিয়া দ্রুত হেঁটে ওর পাশে দাঁড়ায়।
: জাস্ট এ মিনিট আই ওয়ান্ট টেল ইউ ওয়ান থিং
যুবক জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
: ইউ টোল্ড মি আরলিয়ার দ্যাট ইউ হ্যাভ এ কালচারাল প্রাইড। অনেস্টলি আই ওয়ান্ট টু সে দ্যাট ইয়োর প্রাইড ইজ জেনুইন।
: হোয়াই।
এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না রাজিয়া। ওর বিশ্বাস এ জবাব যুবক নিজেই খুঁজে পাবে। ও এগোয়। ওর চেয়েও দ্রুত পা ফেলে এগোয় ভিনদেশী যুবক। একজন নারী হয়েও যার কাছে একটি অন্ধকার একাকী রাতে সে ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ।