ফেনী
মঙ্গলবার, ২১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৪:৪৫
, ২৮শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

নুসরাত হত্যায় সংবাদ প্রকাশঃ প্রতিশোধ নিতেই সাংবাদিকদের মামলায় জড়ালেন এসপি জাহাঙ্গীর!

বহুল আলোচিত ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় গোপনে সাংবাদিকদের মামলায় ফাঁসিয়ে দিলেন ফেনী থেকে প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার।রাফী হত্যার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ফেনী ছাড়ার আগে তিনি বিভিন্ন থানার ওসিদের ডেকে কয়েকজন সাংবাদিককে মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি সমঝোতা হওয়া মামলায়ও চার্জশীট দিতে বাধ্য করেন।
এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের চার্জশিটে নাম অন্তর্ভূক্ত করতে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের এসিআর আটকে রাখেন ফেনীর সাবেক বিতর্কিত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর সরকার।
২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফী। ওইদিনই অধ্যক্ষকে পুলিশ আটক করে। এ ঘটনায় রাফীর মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে থানায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানীর মামলা দায়ের করেন।মামলা প্রত্যাহার করতে হুমকি-ধমকি দেন অধ্যক্ষের সাঙ্গপাঙ্গরা। একপর্যায়ে ৬ এপ্রিল পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে মাদরাসার ছাদে ডেকে নিয়ে  নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের অনুসারীরা। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করে। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়।
শুরু থেকেই ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রচার করেন সোনাগাজী মডেল থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি (বর্তমানে গ্রেফতার) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তার পক্ষে অবস্থান নেন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার। ঘটনাটি নিয়ে যখন দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম সরব, এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই রাফীর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, এমনকি ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দেন, তখনও ঘটনাস্থলে যাননি এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। মামলায় সিরাজ উদ-দৌলাসহ কয়েকজনকে আসামী করতে এসপি-ওসি তালবাহানা করেন বলে রাফীর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে। শুধু তাই নয়, পুলিশ সদর দপ্তরে ওসির পক্ষে সাফাই গেয়ে চিঠি লিখেন এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। তাদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তরের পর ঘটনায় জড়িতরা একে একে গ্রেফতার হতে থাকে। বেরিয়ে আসে মূল রহস্য। একপর্যায়ে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে রাফীর ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলায় এসপি-ওসিসহ ৪ পুলিশ দোষী সাব্যস্ত হন। ওসি মোয়াজ্জেমকে বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। আর এসপি জাহাঙ্গীর সরকারকে প্রত্যাহার করে সংযুক্ত করা হয় পুলিশ সদর দপ্তরে। অপর দুইজনকেও প্রত্যাহার করে পার্বত্য এলাকায় সংযুক্ত করা হয়।
এদিকে নুসরাত জাহান রাফীর জবানবন্দীর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ব্যারিস্টার সুমন। ওই মামলায় বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন ওসি মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম অবস্থায় এ ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে তার মোবাইল থেকে ফুটেজটি চুরির অভিযোগ এনে সময় টিভির ফেনী ব্যুরোর রিপোর্টার আতিয়ার হাওলাদার সজলের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সজলও পাল্টা ডায়েরি করেন।
জেলা পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসপি জাহাঙ্গীর সরকার ফেনী ছাড়ার আগেই কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় তিনি এ ঘটনায় তাকে নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন সাংবাদিককে হেনস্থা করার পরিকল্পনা নেন। তাদের নাম সংবলিত একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ধরিয়ে দেন। বিভিন্ন তদন্তাধীন মামলায় উল্লিখিত সাংবাদিকদের নাম চার্জশীটে অন্তভূক্ত করার নির্দেশ দেন। কয়েকজন ওসি কৌশলে এড়িয়ে গেলেও অন্যদের এসিআরের ভয় দেখিয়ে আদালতে চার্জশীট দাখিলের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন জাহাঙ্গীর সরকার। ১২ মে সন্ধ্যায় তার বদলী আদেশ আসার পর তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশীট তৈরি করান। এবং পরদিন তা দাখিলে বাধ্য করেন বলে নাম প্রকাশ না-করার শর্তে একাধিক ওসি জানান। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতেও কোর্ট পরিদর্শকসহ অন্যদের নির্দেশ দেন তিনি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় ৩, সোনাগাজী মডেল থানায় ২, দাগনভূঞা থানায় ২ ও ছাগলনাইয়া থানায় ২টি মামলার চার্জশীট আদালতে জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব মামলার অধিকাংশই বাদী পুলিশ।
প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা গেছে, জমা দেয়া চার্জশীটে সাংবাদিকদের মধ্যে দৈনিক ফেনীর সময় ও সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনী সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, দৈনিক অধিকারের ফেনী প্রতিনিধি ও অনলাইন পোর্টাল ফেনী রিপোর্ট সম্পাদক এস এম ইউসুফ আলী, অনলাইন পোর্টাল বাংলানিউজ ২৪ডট কমের স্টাফ রিপোর্টার ও সাপ্তাহিক হকার্সের বার্তা সম্পাদক সোলায়মান হাজারী ডালিম এবং দৈনিক সময়ের আলো’র ফেনী প্রতিনিধি ও দৈনিক স্টারলাইনের স্টাফ রিপোর্টার মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারীর নাম রয়েছে।
তদন্তকারি সূত্র জানায়, মামলার এজাহারে এদের কারোর নাম না-থাকলেও চার্জশীটে তাদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উল্লিখিতদের নামে ফেনীর কোন থানায় ইতোপূর্বে সাধারণ ডায়েরিও ছিল না। বিতর্কিত এসপি জাহাঙ্গীর সরকারের রোষানলে পড়ে একসপ্তাহের মধ্যে তারা প্রায় ১০টি মামলার চার্জশীটে আসামী হন। বিষয়টি জানাজানি হলে ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিক ও সচেতন মহলে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া ছাগলনাইয়া উপজেলায় কর্মরত দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে দায়েরকৃত মামলা বাদীর সঙ্গে সমঝোতা হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়। অনলাইন পোর্টাল ছাগলনাইয়া ডট কম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির লিটন ও যুগান্তর’র ছাগলনাইয়া প্রতিনিধি নুরুজ্জামান সুমন জানান, প্রতিহিংসাবশত এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকারের নির্দেশে ওসি (তদন্ত) সুদীপ রায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে।
ইতোমধ্যে ফেনীর সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ নবাগত পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবীর সঙ্গে সাক্ষাত করে বিষয়টি অবহিত করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন, নতুন করে আর কোন মামলায় সাংবাদিকদের জড়ানো হবে না। এর আগে জমা দেয়া চার্জশীট নিয়ে তার কিছু করার নেই বলেও তিনি জানিয়েছেন।

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo
error: Content is protected !!