হাসান শরীফ-
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল মিল-অমিল
ইসরাইলের সবধরনের অন্যায় কাজ, নৃশংসতা যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে, সব আবদার যেভাবে মেনে নেয় এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টরা নির্বাচনের আগে ও পরে যেভাবে তাদের ইহুদিপ্রেম প্রকাশ করে থাকেন তাতে করে মনে হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সহায়তা করছে না বরং ইসরাইলের দয়ায় টিকে আছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রকাশ্যভাবে এর দু’টি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। একটি মিডিয়া, অপরটি সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান মিডিয়া ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে। আর আছে অর্থ। বিশ্বের অর্থসম্পদের একটি বড় অংশের মালিক ইহুদিরা। এ দু’টি এবং এগুলো নিয়ে গঠিত ইহুদি লবির সহায়তা না পেলে যুক্তরাষ্ট্রে কারো পক্ষে প্রেসিডেন্ট কিংবা কংগ্রেস সদস্য হওয়া কিংবা টিকে থাকা সম্ভব নয় বলে প্রায় সবাই স্বীকার করেন। তবে শুধু অর্থ বা মিডিয়ার কারণে নয়, এগুলোর নেপথ্যে থাকা ধর্মবিশ্বাসই বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সম্ভবত ইহুদিরা ওই ধর্মবিশ্বাসই কৌশলে ব্যবহার করে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল আছে। আবার অমিলের হিসাবটাও কম নয়।
যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গঠিত হয়েছে এর সংস্কৃতি, ধর্ম, সংবিধান সব কিছুই ইহুদিদের প্রতি দেশটির একটি বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটিতে সরকারিভাবে কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না। আমেরিকান সংবিধান সেকুলার, এতে সতর্কতার সাথে খ্রিষ্টধর্মের কথা উল্লেখ করা হয়নি এবং রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা রাখা হয়েছে। তবে এটা কাগজে-কলমের কথা। বরং দেশটির প্রতিষ্ঠাতারা যে গ্রেট সিল তৈরি করেছিলেন তাতে খ্রিষ্টধর্মকে কেন্দ্র করেই জাতি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, মেঘ ও আগুনকে অনুসরণ করে ইসরাইল-সন্তানেরা প্রতিশ্র“ত-ভূমি তথা জেরুসালেমের দিকে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গদের ঔপনিবেশ গড়ার বিষয়টিও লক্ষ করা জরুরি। আমেরিকায় নতুন ঔপনিবেশ খোঁজার জন্য হাজার হাজার পিউরিটান প্রথম চার্লসের চার্চ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা বাইবেলে বর্ণিত জেরুসালেমের কাহিনীতে বিশ্বাস করতেন। তাদের অনেকে মনে করতেন, যে আমেরিকাই বাইবেলে বর্ণিত জেরুসালেম কিংবা ইসরাইল। ধর্মীয় স্বাধীনতার সন্ধানে আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার সময়ে তারা বাইবেলগুলোতে জেরুসালেম ও ইসরাইলি-সংক্রান্ত বক্তব্যগুলো পাঠ করছিলেন এবং নিজেদের কেনানের জনশূন্য প্রান্তরে একটি নতুন জায়ন নির্মাণে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট মনোনীত লোক মনে করতেন। মে ফ্লাওয়ার থেকে অবতরণের সময়ে উইলিয়াম বেডফোর্ড প্রার্থনা করেছিলেন, ‘আসুন আমরা জায়নে ঈশ্বরের কথা ঘোষণা করি’। ম্যাসাচুসেটস বে কলোনির প্রথম গভর্নর জন উইনথ্রপ বিশ্বাস করতেন, ‘ইসরাইলের ঈশ্বর আমাদের মধ্যে আছে’ এবং জেরেমিয়াহ ও ম্যাথুর আলোকে তার আবাসস্থলকে ‘পাহাড়ের ওপর নগরী’ (অর্থাৎ আমেরিকাই হলো নতুন জেরুসালেম) হিসেবে অভিহিত করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে ১৮টি জর্দান, ১২টি কেনান, ৩৫টি বেথাল, ৬৬টি জেরুসালেম বা সালেম আত্মপ্রকাশ করে। অবশ্য সময়ের পরিক্রমায় বাইবেলের সাথে সম্পর্কিত এসব স্থানের প্রতি আবেগ টিকে থাকেনি। অল্প সময় পরে তারা আসল জেরুসালেম, আসল জর্দান, আসল কেনানের দিকে দৃষ্টি ফেরায় এবং এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে ইহুদিরা।
যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টানদের একটি বড় অংশই মনে করে যিশুখ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমনের (সেকেন্ড কামিং) পরে কেয়ামত হবে। তবে যিশুখ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমন নিশ্চিত করতে হলে ইহুদিদের সেখানে জড়ো করতে হবে। যিশুখ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমনের অল্প আগে এসব ইহুদি হয় নিহত হবে, কিংবা খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নেবে।
আর ইহুদিদের জেরুসালেমে পাঠানোর কাজ আমেরিকানেরা জোরালভাবে করে যাচ্ছে সেই ১৯ শতক থেকে। এমনকি ১৮৪৪ সালে ওয়ার্ডার ক্রেসন নামে একজনকে জেরুসালেমের মার্কিন কনস্যাল জেনারেল করে পাঠানো হয়েছিল। ১৮৪৭ সালে সেকেন্ড কামিং (দ্বিতীয় আগমন) হবে এ ব্যাপারে তার নিশ্চিত বিশ্বাসই ওই পদে তার নিয়োগের একমাত্র যোগ্যতা ছিল। তিনি খোলামেলাভাবেই তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতেন। জেরুসালেমে তুর্কি সরকারের প্রতিনিধি পাশার সাথে সাক্ষাৎকালে ক্রেশন ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, তিনি আসন্ন মহা প্রলয় (অ্যাপোক্যালিপস) এবং ইহুদিদের প্রত্যাবর্তনের জন্য এসেছেন। এই কাজ তাদের অনেকে এখনো করে যাচ্ছেন।
১৯ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিষ্টধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগের সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকেই নিজেদের প্রফেট দাবি করতেন। বড় বড় শহর তো ছিলই এমনকি ছোট, পশ্চাদপদ খনি শহরের কাঠের চার্চ, সীমাহীন রুক্ষভূমিতে প্রতিষ্ঠিত গোলাবাড়ি, বাড়ন্ত নতুন নতুন শিল্পনগরীতে আমেরিকার নতুন প্রতিশ্র“ত ভূমির ধর্মপ্রচারকেরা প্রাচীন রূপকবর্জিত বাইবেলিক প্রত্যাদেশের উদ্ধৃতি দিতেন। ইভানজেলিক বিশেষজ্ঞ এবং জেরুসালেমের বাইবেলিক প্রতœতত্ত্ব প্রতিষ্ঠাতা ড. এডওয়ার্ড রবিনসন বলেন, ‘অন্য কোনো দেশে ধর্মগ্রন্থগুলো এত বেশি পরিচিত ছিল না।’ প্রথম দিকের আমেরিকান মিশনারিরা বিশ্বাস করতেন যে নেটিভ আমেরিকানেরা (রেড ইন্ডিয়ান) হলেন ইসরাইলের হারানো গোত্র (লস্ট ট্রাইব); প্রতিটি খ্রিষ্টানকে অবশ্যই জেরুসালেমে সত্যনিষ্ঠ কাজ, ইহুদিদের প্রত্যাবর্তন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতে হবে। দ্বিতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস লিখেছেন : ‘আমি আন্তরিকভাবে চাই যে ইহুদিরা আবার স্বাধীন জাতি হিসেবে জুদাইয়ে যাক।’
এমনকি উইলিয়াম মিলার নামের এক আমেরিকান দৈব-বার্তা ঘোষণাকারী (প্রফেট) ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন। ম্যাসাচুসেটসের এই সাবেক সেনাকর্মকর্তা হিসাব করে দেখান যে ১৮৪৩ সালে জেরুসালেমে যিশুখ্রিষ্ট আবার আসবেন। তার প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে এক লাখ আমেরিকান তার মিলেরাইটস সম্প্রদায়ে যোগ দিয়েছিলেন। ড্যানিয়েল ৮.১৪-এ উল্লিখিত ‘পুণ্যস্থানটি দুই হাজার তিন শ’ দিনের মধ্যে পবিত্র হবে’-এর নতুন ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এখানে উল্লিখিত দিনের অর্থ বোঝাচ্ছে বছর, দৈব-বার্তার দিন বলতে বছর বোঝানো হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫৭ সাল (যে বছরে পারস্যরাজ প্রথম আরতাজারেজসের টেম্পল নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন) থেকে হিসাব শুরু করে মিলার পৌঁছালেন ১৮৪৩ সালে। তবে ওই বছরে কিছু না ঘটলে তিনি ১৮৪৪ সালের কথা বললেন। উল্লেখ্য, মিলেরাইটের উত্তরসূরি চার্চ সেভেন্থ ডে অ্যাডভেটিস্টরা এবং জেহোভাস উইটনেসেস ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা এখনো বিশ্বব্যাপী ১৪ মিলিয়ন।
এই বিশ্বাসের কারণেই ২০ শতকে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কিংবা ২১ শতকে ইহুদি রাষ্ট্রটির শক্তিশালী অবস্থানে থাকার প্রতি আমেরিকার শর্তহীনভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন আমেরিকা ও ইসরাইলের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে : উভয় দেশই ঐশ্বরিক আশীর্বাদপুষ্ট স্বাধীনতার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত : একটি নতুন জায়ন, ‘পাহাড়ের ওপর নগরী’ এবং অপরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত পুরনো জায়ন। আমেরিকান ইহুদিরা আগেই আগ্রহী সমর্থক হয়ে পড়েছিল, তবে এখন আমেরিকান ইভানজেলিস্টেরা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে ইসরাইল হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় যে আমেরিকানদের ৪০ শতাংশের বেশি জেরুসালেমে দ্বিতীয় আবির্ভাবে (সেকেন্ড কামিং) বিশ্বাস করেন। এটা যত অতিরঞ্জিতই হোক না কেন, আমেরিকান খ্রিষ্টান জায়নবাদীরা ইহুদি জেরুসালেমের প্রতি তাদের সমর্থন প্রদান করেছেন এবং ইসরাইল এতে সন্তুষ্ট, যদিও তাদের কেয়ামতের দিনের দৃশ্যপটে ইহুদিদের ভূমিকা মর্মান্তিক।
প্রতিদিন আমেরিকান করদাতারা দিচ্ছেন ৮০ লাখ ডলার
আমেরিকার তুলনায় ইসরাইল অতি ক্ষুদ্র একটি দেশ। ৫৮ লাখ জনসংখ্যার দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার চেয়েও ছোট। অথচ দেশটি পৃথিবীতে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি আমেরিকান টাকা পেয়ে থাকে। রাজস্ব বছরের শুরুতে এই বরাদ্দ দেয়া হয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে সুদ দিতে হয়, আর ইসরাইল এই টাকা ব্যাংকে রেখে বাড়তি সুদও পেয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এখন যেহেতু ঘাটতি বাজেট মোকাবেলা করছে, তখন এই বরাদ্দ নিয়ে কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছেই। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ওয়াশিংটন রিপোর্টের সম্পাদক রিচার্ড কারটিস চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য উত্থাপন করেছেন। এখানে সেগুলো তুলে ধরা হলো।
এখন অনেক আমেরিকানই জানেন যে মাত্র ৫৮ লাখ জনসংখ্যার দেশ ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্যের বৃহত্তম গ্রহণকারী এবং ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তির কারণে মিসরকে যে সাহায্য দেয়া হয় তা এক করলে পরিমাণটা বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সাহায্য বাজেটের অর্ধেকের বেশি দাঁড়ায়।
এখানেই শেষ নয়, এ ধরনের সাহায্য ছাড়াও আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী লবি থাকায় আরো নানাভাবে মার্কিন অর্থ ইসরাইলে যায়।
আর্থিকভাবেই নয়, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে আমেরিকান জীবনহানিও ঘটছে। মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য মার্কিন সেনা, কূটনীতিক, বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। মিডিয়ায় এসব খবর গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। তবে এর নেপথ্যে যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলকেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্য নীতি তা নিয়ে খুব কমই আলোকপাত করা হয়।
ইসরাইলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে ধরনের ক্ষতি বরণ করতে হচ্ছে সেটাকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
আর্থিক ক্ষতি
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র যত পরিমাণ সাহায্য দিয়েছে তা সাব-সাহারীয় আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোকে সম্মিলিতভাবে যত সাহায্য দেয়া হয়েছে তার অর্ধেক। ইসরাইলের জনসংখ্যা যেখানে ৫৮ লাখ, সেখানে ওই দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ১০৫ কোটি ৪০ লাখ। অর্থাৎ ৫৮ লাখ লোককে যুক্তরাষ্ট্র যত সাহায্য দিয়েছে তার অর্ধেকও দেয়া হয়নি দরিদ্রপীড়িত বিশ্বের সাড়ে ১০৬ কোটি মানুষকে।
উদারহণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৭ অর্থবছরে ইসরাইল বৈদেশিক সাহায্য বাজেট থেকে পেয়েছে ৩০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বাজেট থেকে অন্তত ৫২৫ মিলিয়ন ডলার, ফেডারেল লোন গ্যারান্টি দুই বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র মোট মঞ্জুরি ও ঋণ নিশ্চয়তা দিয়েছে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। এর সরল হিসাব হচ্ছে ৩৬৫ দিনের বছর হিসেবে দিনে ১৫,০৬৮,৪৯৩ ডলার।
এর সাথে বৈদেশিক সাহায্য মঞ্জুুরি, ঋণ এবং মার্কিন ফেডারেল বাজেট-বহির্ভূত খাতগুলো থেকে দেয়া অর্থ যোগ করা হলে ইসরাইলকে দেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৪.৪ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া রয়েছে ইসরাইলকে দেয়া ১০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন সরকারের ঋণ নিশ্চয়তা। এই গ্যারান্টির সুদের হিসাবটি আমলে আনলে ইসরাইলকে দেয়া লোন গ্যারান্টির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩৪.৮ বিলিয়ন ডলার।
এই হিসাবগুলো অন্যভাবেও করা যায়। ১৯৯৭ সালের ৩১ অক্টোবর নাগাদ ইসরাইলের ৫৮ লাখ নাগরিকের প্রত্যেকে প্রায় ১৪,৬৩০ ডলার করে পেয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিটি ইসরাইলি আমেরিকান করদাতাদের কাছ থেকে ২৩,২৪১ ডলার করে পাচ্ছেন। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি ইসরাইলি পরিবার পান ১১৬,২০৫ ডলার।
এই হিসাবের মধ্যে আমেরিকানদের ব্যক্তিগতভাবে ইসরাইলে দাতব্য কাজে যেসব অর্থ দিচ্ছে তা ধরা হয়নি। পরিমাণটা কিন্তু কম নয়, ইসরাইলি বাজেটের এক-চতুর্থাংশ, আজকের হিসাবে বছরে ১০০ কোটি ডলার। এই অর্থ আরেকভাবে মার্কিন অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। দাতব্য কাজে প্রদত্ত অর্থের আয়কর দিতে হয় না। এর ফলে মার্কিন কোষাগার আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই হিসাবের মধ্যে আরেকটি হিসাবও বাদ পড়েছে। ইসরাইলের প্রতি আমেরিকান সমর্থনের কারণে আরব দেশগুলো আমেরিকান পণ্য বয়কট করছে। এর ফলে আমেরিকার কত ক্ষতি হচ্ছে তা নিরূপণ করা হয়নি। তবে সেটা বিলিয়ন বিলিয়ন হবে সেটা নিশ্চিত। এই ক্ষতির একটি উদাহরণ হচ্ছে পেট্রোলিয়ামের মূল্যজনিত ব্যয়। ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থনের প্রতিক্রিয়ায় আরব তেল বয়কটের সময় বিশ্বজুড়ে মন্দা দেখা দেয়।
ইসরাইলকে রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আরেকভাবে খরচ করতে হচ্ছে। সেটা হচ্ছে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তাকে তার ষষ্ট নৌবহর মোতায়েন করে রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়াও আছে ইতালির অ্যাভিয়ানো ঘাঁটিতে সামরিক বিমান ইউনিট। আরো আছে আরব উপদ্বীপ ও উপসাগরীয় এলাকায় স্থল ও বিমানবাহিনী মোতায়েনের ব্যয়।
কয়েক বছর আগে পরলোকগত মার্কিন আন্ডারসেক্রেটারি জর্জ ব্যাল হিসাব করে দেখিয়েছেন যে ইসরাইলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আসল ব্যয় হচ্ছে বছরে ১১ বিলিয়ন ডলার। এর পর থেকে ইসরাইলে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক সাহায্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং মূল হিসাবটি ১৯৯৮ সালের ডলারের সাথে সমন্বয় করা হলে ওই অঙ্কটি এখন অনেক বেশি হবে।
আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যয়
এরপরে আসা যাক ইসরাইলের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে হিসাবে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা হতবাক করা বিষয়। এই ব্যর্থতার মূলক কারণ ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা না থাকা। আবার যুক্তরাষ্ট্রে মূলধারার মিডিয়ায় এসব তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
১৯ শতকের শেষভাগে যখন ইউরোপে রাজনৈতিক জায়নবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটছিল, তখন ইহুদিরা ছিল জেরুসালেমের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠী। জেরুসালেম ও ফিলিস্তিন তখনই অত্যন্ত জনবহুল দেশ, বহিরাগতদের স্থান দেয়ার মতো শূন্যতা সেখানে ছিল না।
এমনকি ১৯৪৭ সালেও, অর্ধশতাব্দীকালের জায়নবাদী অভিবাসন ও হিটলারের কারণে আগত ইহুদি উদ্বাস্তুসহ, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে থাকা ফিলিস্তিনে ইহুদির সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। মাত্র ৭ শতাংশ ভূমির মালিক ছিল ইহুদিরা। তবুও জাতিসঙ্ঘ যখন ফিলিস্তিন ভাগ করে, মোট ভূমির মধ্যে ইহুদি রাষ্ট্রকে দেয় ৫৩ শতাংশ এবং আর আরবদের মাত্র ৪৭ শতাংশ। এতে জেরুসালেমকে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে ‘স্বাধীন সত্তা’ হিসেবে রাখার প্রস্তাব করা হয়।
আমেরিকানদের মধ্যে একটি মিথ এখনো চালু রয়েছে যে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ব্রিটিশ প্রত্যাহারের পর আরব ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণ ছিল মিসর, জর্দান, ইরাক ও সিরিয়া বাহিনীর ফিলিস্তিনে প্রবেশ। তাদের মধ্যে এই ধারণাও বিদ্যমান যে আরবেরা পার্টিশন প্লানটি প্রত্যাখ্যান করেছিল, আর ইসরাইল সেটা গ্রহণ করেছিল।
বাস্তবে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল আরো ছয় মাস আগে, পার্টিশন প্লান ঘোষণার পরপরই। আরব সেনাবাহিনীগুলো যখন হস্তক্ষেপ করে, তখন প্রায় চার লাখ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। আরব দেশগুলো জাতিসঙ্ঘ এলাকা থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনি জনগণকে রক্ষা করতে সামরিক বাহিনী পাঠিয়েছিল। এমনকি জর্দানি বাহিনীকে ইসরাইলকে দেয়া জাতিসঙ্ঘ এলাকায় প্রবেশ না করতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
নবগঠিত ইসরাইলি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টিশন প্লানটি প্রত্যাখ্যান না করলেও বাস্তবে তারা সেটা কখনো গ্রহণও করেনি। আজকের দিনে, অর্ধ শতাব্দী পরে, ইসরাইল এখনো তার তার সীমানা চূড়ান্ত করেনি।
১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ শেষ হলে দেখা যায়, ইসরাইল জেরুসালেমের অর্ধেক এবং সাবেক ফিলিস্তিন ম্যান্ডেটের ৭৮ ভাগ দখল করে ফেলেছে। প্রায় সাড়ে সাত লাখ মুসলমান, খ্রিষ্টান ফিলিস্তিনিকে তাদের শহর, গ্রাম ও বাড়ি থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাদের আর কখনো ফেরার অনুমতি দেয়া হয়নি।
এরপরে চারটি যুদ্ধ হয়। এগুলোর মধ্যে তিনটিই শুরু করেছিল ইসরাইল (১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৮২)। মিসর ও সিরিয়া মাত্র একটি যুদ্ধ শুরু করেছিল। সেটা ১৯৭৩ সালে, তাদের অধিকৃত এলাকা পুনরুদ্ধারের জন্য। ইসরাইল লেবানন, সিরিয়া, জর্দান ও মিসরের ওইসব ভূমি দখল করেছিল। তার জেরুসালেমের অর্ধেক অংশ এবং ফিলিস্তিনের ২২ শতাংশ এলাকাও দখলে রেখেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকারই এই ঐতিহাসিক তথ্য স্বীকার করেনি। আর এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ হয়েছে। ইসরাইলি বাহিনীর হাতে থাকা এলাকায় ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন সত্ত্বেও ইসরাইলের অনুকূলে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোশক্তির অপব্যবহারে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের যেসব সরকার একসময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বিবেচনা করত ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশ শক্তির হাত থেকে রক্ষাকারী, তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট গঠনের কারণে মধ্যপ্রাচ্য সরকারগুলো বিপদে পড়ছে।
ইসরাইলের শক্তিশালী ও প্রতারণামূলক লবি
ইসরাইলের জন্য আমেরিকার যেসব ক্ষতি হচ্ছে তার আরেকটি ক্ষেত্র হলো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিকব্যবস্থা। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ফরচুন ম্যাগাজিনে পেশাদার লবিস্টদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তাদের মতে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশেষ স্বার্থ গ্র“প কোনটি। তারা ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড পারসনস’ নামে সংগঠনের কথা বলে। এই সংগঠন ৬০ ঊর্ধ্ব সব আমেরিকানের জন্য কাজ করে। দ্বিতীয় স্থানে ছিল আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি)। ১৫০ জন কর্মী-সংবলিত তাদের বার্ষিক বাজেট ১৫ মিলিয়ন ডলার। তাদের অর্থের উৎস তারা কখনো প্রকাশ করেনি। তবে সংগঠনটি মেজর আমেরিকান জুইশ অরগানাইজেশনের (প্রায় ৫২টি জাতীয় ইহুদি সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য গঠিত গ্র“প) সভাপতিদের সম্মেলন থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে।
এসব সংগঠনের মধ্যে বি’নাই বি’রিথ’স অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগ (এডিএল) ও হাদাসা। এডিএলের বার্ষিক বাজেট ৪৫ মিলিয়ন ডলার। হাদাসা হলো ইহুদি নারী গ্র“প। তাদের বাজেট এআইপিএসির চেয়েও বেশি। তারা প্রতি বছর ইসরাইল সরকারের তত্ত্বাবধানে সফরের জন্য হাজার হাজার আমেরিকানকে ইসরাইলে পাঠিয়ে থাকে।
এআইপিএসি ও এডিএল উভয়েই গোপন ‘বিরোধী গবেষণা’ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে। এতে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বিদ্বজ্জন ও সংগঠনগুলোর ফাইল তৈরি করে, ইসরাইলপন্থী গ্র“পগুলো এবং কর্মীদের কাছে বিতরণের জন্য স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে তথ্য সরবরাহ করে। তাদের লক্ষ্য যারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদেরকে ‘ইসরাইলের শত্র“’ হিসেবে অভিহিত করে সুনামহানি করা। একবার পুলিশ এডিএল অফিসে হানা দিয়ে দেখতে পায় যে লস অ্যাঞ্জেলেস ও সান ফ্রানসিসকো অফিসে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো ভুলে ভরা এবং মানহানিকর। তা ছাড়া অনেক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল অবৈধভাবে।
এআইপিএসির ক্ষেত্রে বলা যায়, এটাই সংগঠনটির সবচেয়ে বিতর্কিত কার্যক্রম নয়। ১৯৭০-এর দশকে এআইপিএসির জাতীয় পরিচালনা পরিষদ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির (পিএসি) আড়ালে জাতীয় নির্বাচনে নিজস্ব প্রার্থী সমর্থন দিতে থাকে। বর্তমানে ইসরাইলপন্থী ১২৬টি পিএসি কমিটি নিবন্ধিত হয়েছে। এ ছাড়া আরো অন্তত ৫০ পিএসি রয়েছে, যারা তাদের যেসব প্রার্থী তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ছেন, তাদেরকে পাঁচ লাখ ডলার পর্যন্ত সহায়তা দিয়ে থাকে। আর এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে নির্বাচিত হওয়ার জন্য টেলিভিশন সময় কেনায় যথেষ্ট।
এআইপিএসি রাজনৈতিক কার্যক্রমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো তাদের সব কিছুই ছদ্মনামে পরিচালিত হয়ে থাকে। ফিলাডেলফিয়ার ডেলাওয়্যার ভ্যালি পিএসি, ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রানসিসক্যানস ফর গুড গভর্নমেন্ট, অ্যারিজোনার ক্যাকটাস পিএসি, নিউ মেক্সিকোর চিলি পিএসি, উইসকনসিনের বিভার পিএসি এবং এমনকি নিউ ইয়র্কের আইস পিএসি যে ইসরাইলপন্থী পিএসি তা কেমন করে বোঝা যাবে? এতে বোঝা যাচ্ছে ইসরাইলি লবির চেয়ে অন্য কেউই নির্বাচনী যুদ্ধে স্বমতের প্রার্থীদের এত বিপুল অর্থসহায়তা করতে পারে না। অন্য কোনো গ্র“পেরই এত কৌশলে কাজ করতেও দেখা যায় না।
আমেরিকার অনেক চৌকস ও প্রতিভাধর কর্মকর্তাকে ইসরাইলি লবির ব্ল্যাকবলের শিকার হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। এ ধরনের একজন হলেন জর্জ বল। তিনি কেনেডি প্রশাসনে আন্ডার সেক্রেটারি এবং জনশন প্রশাসনে জাতিসঙ্ঘে মার্কিন দূতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে তার তুলনা ছিল না। ফলে সবাই ধরে নিয়েছিল, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় দোষ বিবেচিত হলো তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে ফেলেছিলেন। অনেকেই তার সাথে একমত পোষণ করেন, কিন্তু কেউ তা প্রকাশ করেন না, তিনি প্রকাশ করে খেসারত দিতে বাধ্য হলেন।
শুধু তিনিই নন, আরো অনেককে এআইপিএসি ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি যত দিন ইসরাইলমুখী থাকবে, তত দিন এই অন্যায়ও চলতে থাকবে।
আমেরিকান জীবনহানি
এরপরে আসা যাক ইসরাইলের জন্য আমেরিকানদের কি হারে জীবন হারাতে হয়েছে। কেউ কি বিশ্বাস করবে, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের চতুর্থ দিনে ইসরাইলি বিমান ও টর্পেডো মার্কিন রণতরী ইউএসএস লিবার্টি ডুবিয়ে দিয়েছিল? তাতে ৩৪ আমেরিকান নিহত ও ১৭১ জন আহত হয়। ইসরাইল ও আরব সামরিক যোগাযোগ পর্যবেক্ষণের কাজ করছিল জাহাজটি। ইসরাইলি সরকার দাবি করেছে, তারা জাহাজটি চিনতে পারেনি। আরো অবাক করা বিষয় হলো, কংগ্রেস বা আমেরিকান নৌবাহিনী এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত পর্যন্ত করেনি।
আরবদের হাতে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকজন আমেরিকান নিহত হয়েছে। তবে এসব ঘটনার নেপথ্য কারণ হলো ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সমর্থন। আন্তর্জাতিক সব রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ইসরাইল একের পর এক জবরদখল চালিয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই আরবেরা ক্ষিপ্ত হচ্ছে।
মিথ্যা দাবি
ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ইতিবাচক দিক রয়েছে বলে যেসব দাবি করা হয় সেগুলো কখনোই খতিয়ে দেখা হয়নি। রিগ্যান প্রশাসনের আমলে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ সৃষ্টি করা হয়। এতে এই ধারণা কাজ করেছে যে জনসংখ্যা ও আয়তনের দিক থেকে হংকংয়ের চেয়েও ক্ষুদ্র দেশ ইসরাইল ২৫ কোটি আরবের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু আরবদের বিষয়ই নয়, এর সাথে আছে আরো ৭৫ কোটি মুসলমান। তারা বিশ্বের প্রমাণিত তেল ও গ্যাস মজুদের অন্তত ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিপুলসংখ্যক লোককে ক্ষিপ্ত করে ইসরাইলের মতো ছোট একটি দেশকে বেছে নেয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে! অনেকে অস্ত্র নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল সহযোগিতার কথা বলেন। বাস্তবে যে দু-একটি যৌথ অস্ত্র কর্মসূচি সফল হয়েছে, সেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল অর্থসহায়তা ছিল। ইসরাইল তার বেশির ভাগ অস্ত্র পেয়েছে বলা যায় বিনা মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে, অনেক সময় চুরিও করেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ইসরাইল সরকার গোপন মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি অন্যান্য দেশের কাছে বিক্রি করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জরুরি ভিত্তিতে ইসরাইলে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায়। ইসরাইল এই প্রযুক্তি চীনের কাছে বিক্রি করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র দফতর এর প্রমাণ পেয়েছে। ইসরাইলের এই কাজের জন্য চীনা প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় অনুপ্রবেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি তৈরি করতে হয়েছে।
তবে সবচেয়ে ভণ্ডামিপূর্ণ বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসরাইল হলো মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশ। এ ছাড়া বলা হয়ে থাকে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকগতভাবে অনেক মিল আছে। বাস্তবে ইসরাইলি গণতন্ত্র অ-ইহুদিদের জন্য কার্যকর নয়। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার রয়েছে, সেখানে ইসরাইলে মুসলমান ও খ্রিষ্টানেরা সমানাধিকার পায় না, সামরিক বাহিনী কিংবা সামাজিক সুবিধা কোনো ক্ষেত্রেই নয়। এমনকি করব্যবস্থায়ও মুসলমানদের প্রতি সমান আচরণ করা হয় না।
অধিকন্তু ১৯৪৮ সালে ইসরাইল থেকে বিতাড়িত মুসলিম ও খ্রিষ্টান ফিলিস্তিনিদের বংশধরদের তাদের বাড়িঘরে ফিরতে দেয়া হয় না। অথচ কোনো ইহুদি বিশ্বের যেকোনো অংশে জন্মগ্রহণ করলেও তাকে চাহিবামাত্র ইসরাইলের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। আরেকটি খবর বিশ্বের খুব কম লোকই জানেন, তা হলো ইসরাইলের মোট ভূমির ৯০ শতাংশ কঠোর বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত। এখানে অ-ইহুদিদের কোনো অধিকার নেই, এমনকি তারা ইসরাইলের নাগরিক হলেও নয়। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, এই ভূমির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, কমছে না। এর ফলে নাগরিকত্ব, বেসামরিক ও মানবাধিকারের দিক থেকে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে একই ধরনের দেশ হিসেবে অভিহিত করাটা কোনোমতেই যৌক্তিক নয়।