‘কাঁচের দেয়াল’ জহির রায়হানের অসাধারণ সৃষ্টি। পরিবার-পরিজনের মধ্য দিয়ে সমাজ মননে নানা রকম চিন্তার যে প্যাটার্ন, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন চলচ্চিত্রকার। বিশেষ করে পরিবার এবং সমাজে, স্বার্থসিদ্ধ মনন কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে পারে। কখন কোনটাতে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়, তা বিবেচনা না করে পথ চলা একটা মধ্যবিত্তসুলভ বড় চরিত্রও উন্নত জিনিসের প্রতি, উন্নত চরিত্রের প্রতি দৃঢ় আস্থা রেখে পথ যে চলতে পারে না। সেটা আনোয়ার হোসেনের চরিত্রের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকার প্রকাশ করেছেন।
আনোয়ার বেকার তবে শিক্ষিত। বেকার যুবকের সিদ্ধান্ত যেমন সকাল-বিকাল ওঠানামা করে; ঠিক সেরকম চরিত্রে চলচ্চিত্রকার আনোয়ারকে বোঝাতে চেয়েছেন। আবার তরমুজ মামার চরিত্রে নির্মল হাসি, নির্মোহ ভালোবাসা, মানুষের প্রতি দরদ, মায়া-মমতা, দায়িত্বশীলতা, আন্তরিকতা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে। তাই হাসির প্রতি যদি সত্যিকার অর্থে কারো দরদ থাকে, সেটা নানির পরেই মামার অবস্থান।
কেননা একটা মানুষ যখন সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে, যেমন- তরমুজ মামা গান, অভিনয়, কবিতায় আত্মমগ্ন হয়ে থাকে; তখন বাহিরের চরিত্রগুলো বুঝতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। সমস্ত চরিত্র মামার চরিত্রের সাথে ভেরিফাইড হয়, আয়নার মতো সবার চরিত্র মামার চরিত্র দিয়ে পরিষ্কার হয়। তাই যখন হাসি তার প্রথম ভালোবাসা আনোয়ারকে ঘিরে কোনো রকম অনুভূতি কোনোভাবেই প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছিল না, বিশেষ করে বড় মামা-মামি সেজো মামা-মামিদের চার দেয়ালে তৈরি কাঁচের দেয়াল, যার চারপাশেই সব দেখা যায়। কিন্তু অতিক্রম করতে পারা যায় না। ফলে গোপনে সবার চোখের আড়ালে লাজুক হাসি যখন আনোয়ারের কাছে চিঠি পৌঁছায়, অপরাধবোধ যখন আত্মদহন করে; তখন কারো কাছে এসে ভরসা না পেলেও মামার কাছে এসেই হাসি বাকি ভরসাটুকু পায়।
মামার অদ্ভুত সব কাণ্ড-কীর্তি হাসিকে ভাবিয়ে তোলে। অভিনয়ের রিহার্সালের সময় সে মামাকে বলে, ‘মামা, তুমি কি অভিনয় শিল্পী হবে, নাকি গায়ক হবে, না কবি হবে? কোনটা হবে?’ মামা বলে, তিনটাই হবো। দেখ হাসি, অভিনেতা হতে হলে কবির মতো হতে হয়। নয়তো তোর ক্লারিটিই আসবে না। দরদ দিয়ে অভিনয়ই করতে পারবি না। আর গান, গান ছাড়া তো কিছুই হয় না। গানের সুর, বুঝলি গানের সুর তোর মনে একটা অদ্ভুত আমেজ এনে দেয়। কখনো মিষ্টি, কখনো করুণ। তখন হাসি মামাকে বলে, ‘আচ্ছা মামা, আমাকে একটা গান লিখে দিবে?’ মামা তখন বলে, ‘কি ধরনের গান চাস?’ লাজুক ভাগিনী হাসি বললো, ‘মিষ্টি মিষ্টি’। ‘আজ রাতেই খাতা কলম নিয়ে বসবো।’ মামা বলল।
জীবনে রস গন্ধ মেলবন্ধন পরিবার পরিজনের মাঝে কিভাবে কষাঘাত করে আত্মকেন্দ্রিকতা, তা চলচ্চিত্রকার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। আত্মকেন্দ্রিক মানুষের আরও একটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তরুণ-তরুণীদের সামনে। বিশেষ করে বড় কোন জিনিসের প্রতি অহেতুক সন্দেহ, গোপনীয়তা, দরজার খিল বন্ধ করে আলাপচারিতা, কারণ যেই উন্নত সংস্কৃতি উন্নত আদব-কায়দা সমাজ থেকে তারা পেয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে। তা মধ্যবিত্ত তরুণ যুবসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অভিভাবক বয়সীদের চেতনার শক্তিকে তা শাণিত করতে পারেনি। তাই কত অবিশ্বাস, অনাস্থা কাজ করে ছেলেমেয়েদের প্রতি। সিনেমার একটি পর্যায়ে হাসির বাবা মারা যান। মৃত্যুর পর এক লাখ টাকার একটি লটারি পেয়ে যান। যখন দুই মামার ঘরে খবর আসে; তখন তাদের দুটি পরিবার হাসিকে ঘরের বউ করতে চায়। গোপনে গোপনে নানা রকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে। হাসির প্রতি সবার দরদ উথলে ওঠে।
কেউ বলে, হাসিকে জামানের সাথে বিয়ে দেবে। কেউ বলে, আনোয়ারের সাথে। আসলে ব্যক্তির সাথে নয়, পুঁজির সাথে আপোষ করছে দুটি স্বার্থান্বেষী পরিবার। প্রেম-ভালোবাসা থেকে পুঁজিই বড় করে দেখছে জামান-আনোয়ারের বাবা মায়েরা। কারণ তাদের কাছে নির্মোহ সম্পর্কের চেয়ে অর্থই অনেক বড়।
আবার হাসির বাবার লটারির এক লাখ টাকা তাদের একটি মোহ তৈরি করে। যারা কি-না হাসিকে সন্দেহ করতো, অবিশ্বাস করতো। চোর এবং বিশ্বাসঘাতক বলে অবিচার করতো। সেই হাসির বাবার এক লাখ টাকার লোভে হাসির জন্য খাট-পালং, কমলালেবু, হরলিক্স, ডাক্তার, আরও কত কী আয়োজন করে বসে। যা নির্মোহ তরমুজ মামাকে রীতিমতো অবাক করে দেয়। তবে তরমুজ মামা তার সংস্কৃতি দিয়ে বুঝতে পারে, দুটি পরিবারের স্বার্থান্বেষী মতলব।
এক পর্যায়ে দুটি পরিবার হাসিকে কাড়াকাড়ির মাঝে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যায়। মাঝখানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তখনই মামা এসে বলে, ‘তোরা বাড়িটাকে একটা ঝঞ্ঝাট বানিয়ে রেখেছিস। আমি হাজার খানেক সিনেমা দেখেছি। সেখানে তোদের পরিণতি কি হবে? তা-ই বলা আছে। তা আমি চাক্ষুষ বলে দিতে পারি, আলবাত বলে দিতে পারি। তোরা যদি ঝঞ্ঝাট না মিলমিশ করিস, তাহলে কি ঘটবে, মেয়েটা মাঝখানে শুধু বিষ খেয়ে মরবে। আর তোদের বাড়ির মাঝখানের দেয়াল চিরদিনের জন্য বন্ধ থাকবে। তোদের যেকোন এক পক্ষকে সেক্রিফাইস করতে হবে। এছাড়া সমস্যা সমাধান হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেখ ভাই, তোরা সিনেমা দেখোস না বলেই তোদের এতো দুর্দশা। সিনেমার শেষে কি হবে তা তো আগেই বলে দিতে পারি। আরে ভাই, জীবনটা একটা গৎবাঁধা ফরমুলা। মুখস্থ বলে দিতে পারি।’