ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন-ভারত মহাসাগর নামক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ মহাসাগরের সবচেয়ে উত্তরে বৃহত্তম উপসাগর, বঙ্গোপসাগরের অস্তিত্ব আর গুরুত্ব যেন আমরা এই প্রথমবার উপলব্ধি করলাম যখন আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনালে দীর্ঘকাল ধরে ঝুলে থাকা বাংলাদেশ-মিয়ানমার (বার্মা) সমুদ্রসীমা বিরোধ উভয় পক্ষের সন্তুষ্টিতে সমাধান হয়েছে ।
বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সব সময় থাকলেও সময় সময় অধিকতর চর্চিত হয়ে আসছে। বর্তমানে মিয়ানমারে পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশেষ পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ, সর্বোপরি চীনের একচ্ছত্র প্রভাব থেকে সরে আসার প্রয়াস এবং যুক্তরাষ্ট্র তথা ভারতের চীনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। অনেকে আবার মনে করেন এখানকার খনিজসম্পদ, বিশেষ করে ধারণালব্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্তির সম্ভাবনার কারণেই গুরুত্ব আরো বেড়েছে। আমি তেমন মনে করি না। কারণ বঙ্গোপসাগরে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে বা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে তা এখানকার তীরবর্তী দেশের যত না বেশি প্রয়োজন তার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এখানকার ভূরাজনৈতিক বিষয়টিই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে মিয়ানমারের বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে।
সে আলোচনায় পরে আসছি। প্রথমে উপসাগর সম্বন্ধে কিছু তথ্য দেয়া প্রয়োজন। বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগরই শুধু নয়, বঙ্গোপসাগর ত্রিভুজ আকৃতির এবং ভারত মহাসাগরে প্রবেশের পথও বটে। উষ্ণ পানির উপসাগর যার সঙ্গের দেশটি বাংলাদেশ। পূর্বে মিয়ানমার আর ভারতের বিচ্ছিন্ন দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ, আন্দামান-নিকোবার, পশ্চিমে ভারতের পূর্বতীর এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কার পূর্ব দিক। বস্তুত তিনটি প্রধান দেশই বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী। উপসাগরের জলরাশির আয়তন ২,১৭২,০০০ কিলোমিটার। দৈর্ঘ্যে ২০৯০ কিলোমিটার প্রস্থে ১,৬১০ কিলোমিটার এবং গভীরতা গড়পড়তা ২৬০০ মিটার। সবচেয়ে গভীরতম স্থান ৪,৬৯৪ মিটার।
বঙ্গোপসাগর বিশ্বের বৃহত্তম জলরাশি যেটি সবচেয়ে বেশি নদীবিধৌত। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ছাড়াও আরো ছোট ছোট বহু নদী, ভারতের গোদাবরি, মহানন্দা, কৃষ্ণা, কাভেরী ও মিয়ানমারের ইরাবতী। এসব নদী হাজার হাজার টন পলি এই উপসাগরে পৌঁছে দেয়। সে কারণেই এক দিকে যেমন পলি পড়ে কোথাও কোথাও নাব্যতা কমছে আবার একই সাথে খনিজসম্পদের সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।
এই উপসাগরের তীরে রয়েছে ঐতিহাসিক বেশ কিছু বন্দর যা বিশ্বের নৌশক্তিসম্পন্ন দেশের কৌশলগত বন্দর বলে চিহ্নিত রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ভারতের ভিসাখা পট্টম, কলকাতা, পন্ডিচেরী, মাছলিপটনাম, শ্রীলঙ্কার ট্রিঙ্কোমালি, মিয়ানমারের ইয়াংগুন (রেঙ্গুন) এবং সিতাওয়ে। এসব ছাড়া আরো বেশ কিছু বন্দর রয়েছে যার মধ্যে আন্দামান নিকোবারের পোর্ট ব্লেয়ার যার ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে ভারত দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে এবং আন্তর্জাতিক আইসিদ্ধ সমুদ্রপথ (sea dane) পাহারা দেয়ার ক্ষমতাবান হয়েছে। বস্তুত মূল ভারত থেকে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থানের কারণে এই দ্বীপপুঞ্জ ভারতকে পূর্ব বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের পশ্চিম তীরের নিকটতম অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের আইনসিদ্ধ সুযোগ করে দিয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী প্রধান তিনটি দেশ ছাড়াও হিমালয়ের দক্ষিণে স্থলবেষ্টিত দেশ নেপাল এবং ভুটান বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। তেমনি চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জন্য দক্ষিণে মহাসাগরে নির্গমনের সহজ পথও এই বঙ্গোপসাগর। বিগত কয়েক দশক থেকে চীন বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব অনুধাবন করে, বিশেষ করে মিয়ানমারের মাধ্যমে, বঙ্গোপসাগরের তীর পর্যন্ত পৌঁছেছে। অপর দিকে বিগত পঁয়ত্রিশ বছর, বঙ্গোপসাগরের বহির্গমন পথ হওয়ায় চীন বাংলাদেশের সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ কৌশলগত (strategic) পর্যায়ে উন্নীত করেছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কৌশলগত সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। উত্তরে নেপালের সাথে চীনের অভিন্ন সীমান্ত থাকার কারণে যথেষ্ট নৈকট্য পরিলক্ষিত। পূর্বে মিয়ানমার বিগত চার দশক চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক এমন পর্যায়ে উন্নীত করেছিল যে, পশ্চিমা বিশ্ব অত্যন্ত শঙ্কিত হয়েছিল। সে অবস্থা এখন আর তেমন নেই। মিয়ানমারকে প্রায় চার দশক পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র চাপে রাখার কারণে মিয়ানমার চীন হতে অনেকখানি সরে আসতে বাধ্য হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা বাড়েনি বরং সব সময়ই দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ছিল। তবে উপস্থিতি বেশির ভাগ সময়েই আরব সাগর পর্যন্ত অধিক তৎপর ছিল। বিশেষ করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির পর। তার পরের ইতিহাস আফগানিস্তানে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের ইতিহাস। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের মতো সমস্যা জর্জরিত দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি ওই দেশের পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তুলেছে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রও তার মিত্র দেশগুলো সম্ভাব্য পরাজয় এড়াতে কৌশলগত পশ্চাৎপদ হতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে কমব্যাট ফোর্স প্রত্যাহার করে শুধু কিছু সৈন্য মোতায়েন রাখবে। ইতোমধ্যেই নবনির্বাচিত ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রঁসোয়া ওলান্দে ঘোষণা করেছেন, এ বছরের শেষের দিকে ফরাসি সৈনিকদের প্রত্যাহার করে নেবেন। ফরাসি সৈনিকদের প্রত্যাহার করে নিলে অন্যান্য ন্যাটো সদস্যদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে ক্ষেত্রে হয়তো প্রয়োজন পড়বে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের সক্রিয় সহযোগিতার।
আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আটকে পড়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী পাকিস্তানকেন্দ্রিক ছিল। যদিও প্রায় এক দশক ধরে দিল্লির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গভীর হচ্ছিল তবু যুক্তরাষ্ট্রের নজর তেমনভাবে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে পড়েনি যত দিন পর্যন্ত মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ওই দেশের সামরিক জান্তার নীতিতে নমনীয়তা না এসেছে। অপর দিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং প্রায় একঘরে হয়ে থাকা মিয়ানমার শুধু চীনের ভরসায় যে ধরনের উন্নতি করার প্রয়োজন তা করতে পারেনি। ব্যাপক সম্ভাবনার খনিজসম্পদ, বনসম্পদ ও বিপুল জ্বালানির অধিকারী হয়েও মিয়ানমার নিজস্ব অর্থায়নে অপারগতা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিতে পারছিল না। যদিও মিয়ানমার আসিয়ান (ASEAN)-এর সদস্যপদ লাভ করেছে তবুও কোনো আসিয়ান দেশের মতো উন্নতি করতে পারেনি। আসিয়ান অবশ্য মিয়ানমারকে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করতে সাহায্য করেছে।
অবশেষে মিয়ানমার গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সু চির মাধ্যমে নিজের বন্ধ দ্বার উন্মুক্ত করেছে। অং সান সু চি মিয়ানমারের সংসদে উপস্থিত হয়েছেন মাত্র। ক্ষমতার দোরগোড়ায়ও পৌঁছতে পারেনি। সংসদের চরিত্রও বদলায়নি তবুও এতটুকুই যথেষ্ট ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতিতে পরিবর্তন আনতে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন মিয়ানমারকে যাতে চীন মালাক্কা প্রণালীতে প্রভাব বিস্তার করা হতে বিরত রাখা যায়। মূলত এ কারণেই প্রয়োজন বঙ্গোপসাগরের তীরের তিনটি দেশের সহযোগিতার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইদানীং মিয়ানমারে সরবে উপস্থিত হতে শুরু হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিনিধিদের। মিয়ানমারের বর্তমান গণতন্ত্রকেও অগ্রগতি বলে বিপুল লগ্নির পথ খোলা হলো। এসবের প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগরে সরাসরি উপস্থিতি না হলেও নিরাপদ এবং চীনা প্রভাবমুক্ত রাখতে প্রয়োজন হবে তিনটি দেশের সহযোগিতা।
এরই প্রেক্ষাপটে মার্কিন নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে যা চোখে পড়ার মতো। দিল্লির চোখ দিয়ে নয়, ওয়াশিংটনের তৎপরতায় প্রতীয়মান যে, বঙ্গোপসাগরের উত্তরের দেশ বাংলাদেশের সাথে সরাসরি কৌশলগত অবস্থানে থাকতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ইদানীং ওয়াশিংটন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা পাহারা দেয়ার ক্ষমতা বাড়াতে নৌবাহিনীর সাথে সহযোগিতা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নীতির আওতায় ভারত-মিয়ানমার-বাংলাদেশের যৌথ পাহারার প্রয়াস চলছে। অপর দিকে ভারতের নৌবাহিনীকে নীল জলের (Blue Water) নৌবাহিনীতে রূপান্তর করতে সহযোগিতা করে সম্পূর্ণ ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করতে কুণ্ঠিত নয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ভারতে মহাসাগর নীতির সাথে ভারতীয় নৌবাহিনীর স্ট্র্যাটেজিক ফ্রন্টিয়ারের (strategic frontier) ব্যাখ্যার সাথে প্রচুর মিল রয়েছে।
যা হোক, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা চীনকে এতদঞ্চলে সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করতে দিতে যে চায় না তা স্পষ্ট। যে কারণে ভারত মহাসাগরে ভারতের উপস্থিতি জোরদার করা ওয়াশিংটনের নীতির একটি অংশ। একই কারণে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দেশ মিয়ানমার আর বাংলাদেশকে নিদেনপক্ষে কাছে টানার প্রয়াস জোরদার করা দক্ষিণ এশিয়া নীতির অন্যতম পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমার নীতির বলয়ের মধ্যে পরিবর্তিত বাংলাদেশ নীতি। আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গোপসাগর নীতি আরো স্পষ্ট হবে যদি ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমার বিরোধ মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা বিরোধের মতো উভয় দেশের সন্তুষ্টির মাধ্যমে নিষ্পত্তির ধারায় সমাধান হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই বঙ্গোপসাগর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় একবিংশ শতাব্দীতে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
লেখক : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক