ক্লাসরুম সব ফাঁকা, ক্লাস হচ্ছে না। শিক্ষকদের মন ভালো নেই, দুশ্চিন্তায় অস্থির সময় পার করছেন তাঁরা। বুকভরা অভিমান নিয়ে জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকেরা গোমড়া মুখে বসে কর্মবিরতি পালন করছেন! কেউ কেউ মনের হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কিন্তু কেন? কারণ একটাই—দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁদের। বিসিএস ছাড়া শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণের বিরুদ্ধে তাঁরা, অধিকার আদায়ে কর্মবিরতিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
২৭ নভেম্বর সকালে ফরিদপুর সদরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে এমন চিত্রই দেখা গেল। সারা দেশের সরকারি কলেজগুলোর মতো এখানেও চলেছে সর্বাত্মক কর্মবিরতি। ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা (পদার্থবিজ্ঞান) ক্যাডারে চতুর্থ হয়ে এই কলেজে যোগদান করেছি ছয় মাস হলো। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই সময়েই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এসেছে, কিন্তু কখনোই নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে কোনো ধরনের আপস করিনি। কিন্তু আমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারছি আমি এই পেশায় এসে সন্তুষ্ট? পারছি না। একই বিসিএসে যোগদান করে প্রশাসন ক্যাডারের সহকর্মী যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, আমি কি এর অর্ধেকটাও পাচ্ছি? উপরন্তু সারাক্ষণ আমাকে কাটাতে হচ্ছে হতাশায়, ‘আত্তীকরণ’ নামের জুজু সহকর্মীদের মতো আমাকেও ভীত করে তুলছে। ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, এই পেশায় এসে ভুল করলাম কি না।
বর্তমানে একটা ছেলে বা মেয়ে অনার্স করার পর তাঁর স্বপ্নই থাকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সরাসরি দেশের ও জনগণের সেবা করার সুযোগের আশায়। অনার্স বা মাস্টার্স করার পর আরও পাঁচটি ধাপ পেরিয়ে প্রায় ১০০ জনে ১ জন হয়ে দেশের প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হয়েও কেন আমরা এভাবে ভাবছি? কারণটা সহজ, আমাদের অস্তিত্বই যেন আজ হুমকির মুখে!
জানা মতে, বর্তমানে দেশে যত সরকারি কলেজ আছে, তা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এই কথা বিবেচনা করেই আমাদের সবার অভিভাবক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ সরকারি করার ঘোষণা দিয়েছেন বলে জেনেছি। এটা তো খুবই আনন্দের খবর। কিন্তু আনন্দটা নিরানন্দে রূপ নিতে যায় তখনই, যখন শুনি, সরকারি হওয়ার তালিকায় থাকা ২৮৩টি কলেজের শিক্ষকেরা শুধু সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়েই সন্তুষ্ট নন, তাঁরা নাকি নিজেদের শিক্ষা ক্যাডারভুক্তির দাবিও করছেন! তাঁদের এই দাবিকে আমরা অযৌক্তিক বলেই মনে করি, যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সুবিবেচক মানুষই এমনটা মনে করবেন।
আচ্ছা, কোন যুক্তিতে তাঁরা নিজেদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি দাবি করেন? তাঁরা কি বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছেন? হলে কি তাঁরা সরকারি কলেজ ছেড়ে বেসরকারিতে যোগদান করতেন? এমনকি নন-ক্যাডারে যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁরাও তো অন্তত বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসেন। আর এঁরা ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নিয়োগপদ্ধতিতে বেসরকারি কলেজের শিক্ষক হয়ে কোন বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে মানসম্পন্ন নিয়োগ পরীক্ষাকে পাত্তা না দিয়েই বিসিএস ক্যাডার হতে চাইছেন? এই প্রসঙ্গে অনেকে যুক্তি দেখান, বিসিএস ক্যাডার হলেই নাকি ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না। তাঁদের বলি, পড়ানোর যোগ্যতা আছে বলেই বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক তাঁকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা শুধু একজন শিক্ষকই নন, তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাও; সরকার চাইলে দেশের প্রয়োজনে যেকোনো দায়িত্ব তাঁকে দিতে পারেন। কিন্তু বেসরকারি কলেজের শিক্ষকেরা কি প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা? তাঁরা কি সর্বজনস্বীকৃত বিসিএস দিয়ে ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়ার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এসেছেন? অথচ নিজের কথা বলতে পারি, আমি বেসরকারি কলেজের নিবন্ধন পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছিলাম, যাইনি। আবার অনেকে বলবেন, এত দিন এভাবেই হয়ে এসেছে, এখন কেন আপত্তি? তাঁদের বলতে চাই, মৃত্যুর প্রায় আড়াই হাজার বছর পর বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসকে যদি আদালত নির্দোষ বলে রায় দিতে পারেন, তবে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী সন্তানদের যৌক্তিক দাবিটা দেরিতে হলেও মানতে আপত্তি কোথায়?
জনমতের কথা যদি ভাবেন, তবে উদাহরণস্বরূপ ২৬ নভেম্বর প্রথম আলোর জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ৯৩ দশমিক ২৬ শতাংশ পাঠকই শিক্ষা ক্যাডারদের দাবির সপক্ষে মত দিয়েছেন।
এবার আসি, কেন বিসিএস ছাড়া ক্যাডার নয়? কারণ, তাহলে ক্যাডার সার্ভিসের শৃঙ্খলা ও মর্যাদা হুমকির মুখে পড়বে। এতে মেধার অবমূল্যায়ন করা হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে স্বীকৃত উপায়ে বাছাইকৃত সর্বোচ্চ মেধাবীদেরই দরকার। কিন্তু একজন মেধাবী কর্মকর্তা যখন দেখবেন তাঁর চেয়ে কম যোগ্য কেউ এসে হুট করেই সিনিয়র হয়ে গিয়ে তাঁর পদোন্নতিতে বাধার সৃষ্টি করছেন, তখন তিনি আর এই পেশায় থাকতে চাইবেন না, হতাশ হয়ে অন্য পেশায় অথবা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ খুঁজবেন। এই ২৮৩টি কলেজের প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক ক্যাডারভুক্ত হলে আমার মতো নবীন ক্যাডারের সারা জীবনে দুটি পদোন্নতি পাওয়া হবে কি না, সেটিও শঙ্কার বিষয়। সুপারিশ পেয়েও আমার কিছু পরিচিতজন চাকরিতে যোগদান করেননি এসব কারণেই।
আমরা চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন মেনে ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর আলোকে বেসরকারি কলেজগুলো সরকারি হোক, কলেজের শিক্ষকরাও সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান, কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তাঁদের ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে রেখে তাঁদের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক। সেটা না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সুন্দর সাফল্যমণ্ডিত অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যেতে পারে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষার বিস্তার মুখ থুবড়ে পড়বে। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও আহ্বান জানাই, ক্যাডার সার্ভিসের মর্যাদা রক্ষায় আপনারাও এই আন্দোলনে শামিল হোন।
দেব দুলাল গুহ: প্রভাষক, সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ, ফরিদপুর