ফেনী
মঙ্গলবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৮:১৩
, ৩০শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মধ্যপ্রাচ্যে কেন এত সংঘাত….?

 

১০ই ডিসেম্বর ২০১৭, ঢাকাঃ

মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে কঠিন সমীকরন পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পুরো মধ্যপ্রাচ্য যেন একটি জীবন্ত যুদ্ধক্ষেত্র। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, মিশর, ইয়েমেন; সবখানেই এখন যুদ্ধ। ইরাক ও সিরিয়ায় আমেরিকার হামলা এবং গৃহযুদ্ধ যুদ্ধ কেড়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ প্রান, বাবা মা হারিয়ে এতিম হচ্ছে হাজার হাজার শিশু, বাড়িঘর ছেড়ে উদ্ভাস্তু হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। হাজার বছরের মেসোপটোমিয়া সভ্যতা নিমিষে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। লিবিয়ার মত একটি সুখি সমৃদ্ধ দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত হচ্ছে। আরব্য হাজার রজনীর রহস্যময় সেই বাগদাদ নগরী এবং বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন দামেস্ক শহর এখন ভুতুড়ে নগরী। আসুন এর স্বরুপ জানি;

মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র; প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯১৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে । ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে পরাজিত হয়ে অটোমানরা মিশর, লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, হেজাজসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রন হারায়। একই ভাষা, ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী হবার পরেও ফ্রান্স এবং ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্যকে সুকৌশলে বর্তমান মানচিত্রে বহুভাগে বহুদেশে বিভক্ত করে। যাতে করে মুসলিমরা অটোমানদের হাত ধরে আবার ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে এবং হাজার বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি এবং যুদ্ধ লেগে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পতনের অন্যতম কারন মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন, সৌদি আরবের জাতীয়তাবাদী নেতারা, যারা অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমানদের হত্যা করে। ১৯১৭ সালের পরে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের চক্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া ও সুন্নি জনগোষ্ঠীকে আলাদা আলাদা ভুখন্ড না দিয়ে একই দেশে শিয়া এবং সুন্নির মিশ্রন ঘটিয়ে লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, ওমান, জর্ডানকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। এই কারনে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই শিয়া সুন্নির লড়াই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের সাহসী জাতি কুর্দিদের আলাদা একটি স্বাধীন দেশ না দিয়ে তাদের ভুখন্ডকে ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরষ্কের মাঝে ভাগ করে দেয়ার কারনে কুর্দিরাও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। কুর্দিরাও স্বাধীনতার দাবীতে যুগ যুগ ধরে লড়াই করছে ইরাক, সিরিয়া এবং তুরষ্কে। শিয়া-সুন্নি-কুর্দি ত্রিমুখী লড়াইয়ের কারনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমুহ অস্থিতিশীল হয়ে আছে শতাব্দীকাল ধরে। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র আরব উপদ্বীপে প্রতিটি যুদ্ধের মুল কারন।

ইহুদীদের চক্রান্ত; অপরদিকে হাজার হাজার বছর ধরে ইহুদীরা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন দেশে বাস করে আসছে। আবার ইহুদীদের কিছু অংশ খ্রিস্টানদের হাতে মার খেয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ইহুদীদের হঠকারীতা এবং নীচু স্বভাবের কারনে ইউরোপের খ্রিস্টানরা তাদের সবসময়ই শত্রু ভাবতো। বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেক্সপিয়ার কিংবা রুশ কবি টলস্টয়ের গল্পেও ইহুদীদের খারাপ চরিত্র ফুটে উঠে। জার্মান সমাজের বিভক্তির জন্য ‘মাইন ক্যাম্ফ’ বইতে এডলফ হিটলার ইহুদীদের দায়ী করেন। তাই ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় গিয়েই হিটলার ইহুদী দমনে শুরু করেন। অপরদিকে চতুর ইহুদীরা সবসময় পরাশক্তিদের সাথে হাত রেখে নিজেদের জন্য একটি আলাদা ভুখন্ডের দাবী জানাতে থাকে। হাজার হাজার বছর ধরে ইহুদীরা বার বার মার খেয়ে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই তারা একটি স্বাধীন ভুখন্ডে সবাই একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। ব্রিটেনও স্বাধীন ভুখন্ডের স্বপ্ন দেখিয়ে ইহুদীদের ব্যবহার করতো। ইউরোপ এবং আমেরিকার খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করতো যিশুর আগমনের জন্য পৃথিবীর সব ইহুদীকে একত্রিত করতে হবে। যেন যিশু সব ইহুদীকে হত্যা করে পৃথিবীকে ইহুদীমুক্ত করতে পারে। আবার সাধারন জনগনও ইহুদীদের প্রতি বিরক্ত ছিল। তাই ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফো ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদীদের জন্য স্বাধীন ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেন। বিনিময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীদের সমর্থন আদায় করেন। ফিলিস্তিন ছিল তখন ব্রিটেনের দখলে। ইউরোপ ও আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ মাইল ভুমি থাকার পরেও ইহুদীদের ফিলিস্তিনে পুনর্বাসন করার পেছনে ব্রিটেনের উদ্দেশ্য ছিল সুদুরপ্রসারী। প্রথমত, ইহুদীর হঠকারিতা থেকে রক্ষা পাওয়া। দ্বিতীয়ত, আরবের বুকে ইহুদীদের হঠকারিতা ছড়িয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রনে রাখা। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে আসা শুরু করে। ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের সহায়তায় তারা ফিলিস্তিনে জমি কিনতে থাকে। এভাবে সংখ্যালঘু থেকে তারা ফিলিস্তিনের সংখ্যাগুরুতে পরিনত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে ইহুদী নিধনের পর আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদে ইহুদীরা ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিন দখল করে ইসরাঈল নামক রাষ্ট্রের ঘোষনা দেয়। এভাবেই সৃষ্টি হয়, মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাঈল।

কিন্তু ইসরাঈল ভাল করেই জানতো বহুভাগে বিভক্ত মুসলিমরা একত্রিত হলেই তাদের দিন শেষ। তাই ইহুদীরা কখনোই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমুহকে এক হতে দেয় না। মধ্যপ্রাচ্যে বিভক্তি এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেই ইসরাঈল টিকে আছে। এমনকি কোন দেশ শক্তিশালী হয়ে গেলে তাদেরকে আমেরিকার সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়া হয়। লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইরাক যার উদাহরন। কারন কোন দেশ আর্থিক কিংবা সামরিকভাবে এগিয়ে গেলেই ইসরাঈলের বিদায় ঘন্টা বেজে যাবে। লিবিয়ার গাদ্দাফি, সিরিয়ার আসাদ এবং ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ছিলেন ইসরাঈল বিরোধী; তারা সবাই পরমানু বোমা বানানোর চেষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু আমেরিকা ও ইসরাঈলের হামলায় ২০০৭ সালে সিরিয়ার এবং ১৯৮১ সালে ইরাকের পরমানু স্থাপনাসমুহ ধ্বংস হয়ে যায়। এমনকি ভারতের সহায়তায় পাকিস্থানের পরমানু স্থাপনাতেও হামলা চালাতে চেষ্ঠা চালায় ইসরাঈল। ১৯৬৭ সালে ইসরাঈল এক যোগে ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান এবং মিশরে হামলা চালিয়ে সিনাই উপত্যকা এবং গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। কিন্তু আরব দেশ সমুহের আক্রমনে যখন ইসরাইল পরাজিত হবার পথে, তখনই আমেরিকার চাপে আরবরা যুদ্ধবিরতি মানতে বাধ্য হয়। ১৯৪৭ সালেই ইসরাইল ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আরব নেতাদের অদুরদর্শী স্বীদ্ধান্ত এবং পরাশক্তি দেশ সমুহেরদের চাপে আরবরা যখনই জয়ের দ্বারপ্রানে পোঁছে যায় তখনই জাতিসংঘ শান্তি প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়। ইহুদীদের মেধা এবং অর্থকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন এত উন্নত, তাই ইহুদীদের কাছে তারা সবসময়ই বাধ্য থাকে। ১৯১৭ সালের আগে ফিলিস্তিনে ইহুদী ছিল ১০% এর চেয়েও কম, এখন সেখানে ৫০% এর বেশী ইহুদী। ১৯৪৭সালের পর থেকে আমেরিকার মদদে ফিলিস্তিনের ভুখন্ড দখল করেই চলেছে ইসরাঈল। নিজ দেশেই এখন গৃহবন্দি লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি। ইহুদীদের চক্রান্ত মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তির অন্যতম কারন।

তেল কুটনীতি; বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মধ্যপ্রাচ্যে তেল ও গ্যাসের খনি আবিষ্কৃত হয়। শুরু হয় পরাশক্তিগুলোর নতুন রাজনীতি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং রাশিয়া তাদের পুতুল সরকার বসাতে উঠে পড়ে লেগে যায়। ইরানের আলীরেজা শাহ এবং মিশরের আনোয়ার সাদাতকে সমর্থন দেয় ব্রিটেন। জর্ডান, বাহরাইন, সৌদি আরব, কুয়েত ও আমিরাতের বাদশাহদের সমর্থন দেয় আমেরিকা। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং তুরষ্কের সামরিক শাসকদেরও সমর্থন দেয় আমেরিকা। রাশিয়ার সমর্থন পায় সিরিয়ার আল আসাদ। বিনিময়ে শিল্পোন্নত পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যের তেলের মজুদ পেয়ে যায় নিজেদের হাতে। কিন্তু তারপরও ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর আরব দেশসমুহ বাদশাহ ফয়সালের আহবানে পশ্চিমা দেশে তেল রপ্তানী বন্ধ করে দেয়। ইউরোপ এবং আমেরিকা তেলের অভাবে দিশেহারা হয়ে যায়। শুরু হয় আমেরিয়ার নতুন মেরুকরণ।

১৯৭৯ এ ইরানী বিপ্লবের পর পশ্চিমারা আরো বেকায়দায় পড়ে। তাই ১৯৮০ সালে সাদ্দামকে ব্যবহার করে ইরান আক্রমন করায়। তাতেও লাভ না হলে, ১৯৯১ সালে আমেরিকার মদদে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করে নেয়। কুয়েতকে বাঁচানোর অজুহাতে এবং সৌদি রাজবংশকে রক্ষা করতে ইরাক-কুয়েত-সৌদি সীমান্তে সামরিক ঘাটি স্থাপন করে আমেরিকা। এরপরে অন্যান্য দেশেও সৈন্য সমাবেশ ঘটায় আমেরিকা। মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তির কারন একটাই, সেটা হল পশ্চিমাদের তেলের সরবরাহ ঠিক রাখা। যেন ১৯৭৪ এর মত আরবরা আবার একত্রিত হতে না পারে।

ক্ষমতার লালসা; মধ্যপ্রাচ্যের জনবিচ্ছিন্ন বাদশাহরা নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের গোলামে পরিনত হয়ে গেছে। ইরান শিয়াদের মাঝে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, সৌদি আরব সুন্নিদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, আমেরিকা তুলে দিচ্ছে কুর্দিদের হাতে এবং ইসরাঈল তুলে দিচ্ছে জঙ্গীদের হাতে। তাই কোথাও শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ চলছে। কোথাও আইএস-মিলিশিয়া যুদ্ধে লিপ্ত। রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের পরাশক্তি সৌদি আরব এবং ইরান ব্যস্ত নিজেদের আধিপত্য বিস্তার এবং ক্ষমতা ধরে রাখতে।

শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাসের দখল পেতে আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং রাশিয়ার খেলার মাঠ এখন মধ্যপ্রাচ্য। ইসরাঈল সৃষ্টি, রাসায়নিক অস্ত্রের দোহাই দিয়ে ইরাক দখল, শিয়া-সুন্নি লড়াই, আল কায়েদা ও আইএস সৃষ্টি, লেবাননের গৃহযুদ্ধ, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের সংঘাত; সবকিছুই তেলের দখল পেতে। সবখানেই আছে আমেরিকার হাত।

তাই মধ্যপ্রাচ্যের এই লড়াই থামবার নয়। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রের পরিবর্তন ছাড়া এই লড়াই কখনোই থামবে না। ইসরাঈল যতদিন থাকবে, ততদিন মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি লড়াই থাকবে। রাজপ্রাসাদ যতদিন থাকবে, আমেরিকার দাপট ততদিন থাকবে। ভাষা, জাতীয়তা, জাতী গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা ভুলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমুহের উচিত ইসলামকে আকড়ে ধরা। যদি সব দেশ সব জাতি সব ভাষার মানুষ একত্রিত হতে পারে, তবেই আসবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি। কারন জাতীয়তায় কেউ কাতারি কেউবা ইরানি, গোষ্ঠীতে কেউ কুর্দি কেউবা তুর্কি, ভাষায় কেউ আরব কেউবা ফার্সী। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সব মানুষের একটাই সাধারন পরিচয়, তারা সবাই মুসলিম। তাই ইসলামই দিতে পারে তাদের একতার ভিত্তি। দিতে পারে শান্তির গ্যারান্টি।

 

লেখক-

প্রকৌশলী নাজিম সরকার

সহযোগী সম্পাদক, ফেনীর কথা ডট কম

nazimsarkar@gmail.com

ট্যাগ :

আরও পড়ুন


Logo
error: Content is protected !!