জসিম উদ্দিন-দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে বলকান উপদ্বীপের একটি ভূমি পরিবেষ্টিত ছোট দেশ মেসিডোনিয়া। এর উত্তরে সার্বিয়া। পূর্বে বুলগেরিয়া, দক্ষিণে গ্রিস এবং পশ্চিমে আলবেনিয়া। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার সবচেয়ে দক্ষিণের প্রদেশ ছিল এটি। প্রাচীনকালে এই ছোট রাজ্যটিই গ্রাস করে নিয়েছিল পৃথিবীর প্রায় পুরো ভূভাগ। সেই ইতিহাস গড়েছিলেন আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট।
৩৫৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে মেসিডোনে জন্ম নেন তিনি। ইতিহাসের সবচেয়ে সফল এই সমরনায়ক কোনো যুদ্ধে হেরে যাওয়ার নজির নেই। মৃত্যু অবধি একে একে রাজ্য জয় করে চলেছিলেন। বাবা সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপের মৃত্যুর পর তিনি ক্ষুদ্র দেশ মেসিডোনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ফিলিপ বেশ কয়েকটি গ্রিক নগররাষ্ট্র মেসিডোনের অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই জয়ের ধারা আলেক্সান্ডার নিয়ে থামান ভারতীয় উপমহাদেশে।
ইউরোপ-এশিয়ার সংযোগস্থল আনাতোলিয়া দখল করার মাধ্যমে তার বিজয় অভিযান শুরু হয়। এর পর একে একে জয় করেন সিরিয়া, ফোনেসিয়া, গাজা, মিসর, মেসোপটেমিয়া এমনকি বিস্তৃত ভারতীয় উপমহাদেশ। দিগি¦জয়ী আলেক্সান্ডারের শিক্ষক ছিলেন দার্শনিক অ্যারিস্টোটল। ছোটবেলায় পৃথিবীর মানচিত্র নিয়ে জ্ঞান দেন আলেক্সান্ডারকে। সে সময় ছোট আলেক্সান্ডারের মনে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন জাগে। তরুণ বয়সে বাবা মারা গেলে শক্ত হাতে রাজদণ্ড ধরেছিলেন।
মাত্র বিশ বছরের ব্যবধানে প্রায় পুরো বিশ্ব দখলে এসে যায়। রাজ্য বিস্তার আর শাসনভার পরিচালনায় তিনি অত্যন্ত কৌশলী ছিলেন। সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করেন। আবার বিয়ের মাধ্যমে অনেককে আপন করে নেন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজবংশে নিজে বিয়ে করেন। অন্যদেরও এ ধরনের বিয়েশাদিতে উৎসাহিত করেন। অবশেষে ঘাতক ম্যালেরিয়া তার জীবন কেড়ে নেয়।
মেসিডোনিয়া অঞ্চলটি প্রথম পাইয়োনিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাইয়োনিয়া অক্সিয়াস নদীর উত্তর-পূর্ব থেকে মেসিডোনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মেসিডোনের সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপ খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৬ সালে পাইয়োনিয়ার দক্ষিণাঞ্চল দখল করে নেন। আলেক্সান্ডার পাইয়োনিয়া রাজ্যের বাকি অংশ প্রথম জয় করেন। এর পর একে একে পৃথিবীর বিশাল একটা অংশ জয় করে মেসিডোনিয়ার করায়ত্ত করেন। ৫৮০ সালে মেসিডোনে স্লাভদের আগমন ঘটে। উনিশ শতকে এলাকাটি বুলগেরিয়া সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর পর দীর্ঘ সময় নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। কখনো জারদের নিয়ন্ত্রণে, কখানো নরমান শাসকদের দখলে। ১৩ শতকে এসে এটি আবার বুলগেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৪ শতকে এটি সার্ভিয়ান সাম্রাজ্যে ঢুকে যায়। এর কিছুকাল পর তুর্কিরা ইউরোপে প্রবেশ করে। তখন পুরো বলকান এলাকা তুর্কি খেলাফতের অধীনে চলে যায়। দীর্ঘ ৫ শতাধিককাল অব্যাহত মুসলিম শাসন চলে সেখানে। বিশ শতকের শুরুতে জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পর পর দুটো বলকান যুদ্ধ এবং ওসমানিয়া খেলাফত বিলুপ্তির পর দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের তুর্কি শাসিত অঞ্চলগুলো গ্রিস, বুলগেরিয়া এবং সার্বিয়ার মধ্যে ভাগাভাগি হয়।
বর্তমান রিপাবলিক অব মেসিডোনিয়ার নাম হয় ‘সাউদার্ন সার্বিয়া’। ১৯২৯ সালে এটি সাবেক যুগোস্লাভিয়ার প্রদেশে পরিণত হয়। মেসিডোনের নাম দেয়া হয় ‘ভারদার বানোভিনা’। ১৯৪১ সালে এটি বুলগেরিয়া এবং ইতালির দখলকৃত আলবেনিয়ার মধ্যে ভাগাভাগি হয়। ঔপনিবেশিক দমন নিপীড়নে কমিউনিস্ট আন্দোলন দানা বাঁধে। ১৯৪৪ সালে তারা মেসিডোনিয়ার স্বাধীনতা দাবি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি যগোস্লাভ ফেডারেশনের ষষ্ঠ রিপাবলিক হিসেবে প্রকাশ পায়। ১৯৯১ সালে মেসিডোনিয়া শান্তিপূর্ণভাবে যুগোস্লাভিয়া থেকে আলাদা হয়। ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার স্বাদ পায় তারা।
এক নজরে মেসিডোনিয়া
দেশের নাম : রিপাবলিক অব মেসিডোনিয়া
জনসংখ্যা : ২০ লাখ (জাতিসঙ্ঘ ২০০৭)
রাজধানী : স্কোপজে
আয়তন : ২৫ হাজার
৭১৩ বর্গকিলোমিটার
প্রধান ভাষা : মেসিডোনিয়ান, আলবানিয়ান
প্রধান ধর্ম : খ্রিষ্টান, ইসলাম
গড় আয়ু : ৭২ বছর (পুরুষ), ৭৭ বছর (মহিলা)
মুদ্রার নাম : দিনার
প্রধান রফতানি পণ্য : বস্ত্র, লোহা ও ইস্পাত
মাথাপিছু আয় : ৩ হাজার ৪৬০ ডলার।
প্রায় ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটির ভূমি এবড়োখেবড়ো ও শিলা কঙ্করময়। বেশির ভাগ ভূমি গড়ে উঠেছে ভারদার নদী উপত্যকায়, সীমান্তে সারি সারি পাহাড়ে। দেশের দক্ষিণে রয়েছে তিনটি বড় বড় হ্রদ। ধারণা করা হয়, ওহরিড নামের হ্রদটি বিশ্বের প্রাচীনতম হ্রদের একটি। মেসিডোনিয়া উচ্চ ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশ। বর্তমান রাজধানী স্কোপজে ১৯৬৩ সালে উচ্চমাত্রার একটি ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। সারি সারি পর্বতমালাকে কেন্দ্র করে গাছগাছালি তৈরি করে রেখেছে একটি মায়ার পরিবেশ। গ্রীষ্মকাল বেশ উষ্ণ এবং শুকনো আবহাওয়া। শীতের তীব্রতা খুব বেশি না হলেও তুষারপাত হয় ব্যাপক। ছোট হলেও দেশটি তিনটি জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত। ভূমধ্যসাগরীয়, পাহাড়ি এবং মৃদু মহাদেশীয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ এটি। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার আসনসংখ্যা ১২০। প্রতি চার বছর পর সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়। প্রেসিডেন্টের ভূমিকা অলঙ্কারিক। তিনি নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। দুইবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। একটি সাংবিধানিক আদালত রয়েছে। বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করে। ৭৮টি মিউনিসিপ্যালিটির মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রম চলে। রাজধানী স্কোপজের শাসনের জন্য রয়েছে আলাদা দশটি মিউনিসিপ্যালিটি। দেশটির রাজনীতির প্রধান দুটো ধারা। মেসিডোনিয়ানরা জনসংখ্যায় বেশি। জাতিগত আলবেনিয়ানরা সংখ্যালঘু। তবে এ দুই জাতিগোষ্ঠীর মাঝে রাজনৈতিক ভারসাম্য রয়েছে।
ভূমিবেষ্টিত দেশ, তাই নৌবাহিনী নেই। স্থলবাহিনী ও বিমান বাহিনী রয়েছে। মেসিডোনিয়ান স্পেশাল ফোর্সেস নামের আরেকটি বাহিনীও রয়েছে। সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বেশ তৎপর প্রয়োজনীয় কৌশল নির্ধারণে। প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিপরীতে নিজেদের অর্থবহ স্বাধীনতার জন্য কাজ করে তারা।
সম্প্রতি দেশটি ‘বেস্ট রিফরমেটরি স্টেট’-এর তালিকায় ১৭৮টি দেশের মধ্যে চতুর্থ হয়েছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দেশটি ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ধীরে হলেও তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেশ টেকসই বলে মত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ইউরোপীয় দেশের তুলনায় তাদের অর্থনীতি অনেক দুর্বল। এখন দেশে ব্যাপক বেকারত্ব রয়েছে।
মন্টিনিগ্রো, বোসনিয়া হার্জেগোভিনা ও কসোভোর মতো সাবেক যগোসভিয়ার মধ্যে অন্যতম দুর্বল প্রজাতন্ত্র মেসিডোনিয়া। স্বাধীনতার পরপরই দেশটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থাও ততটা উন্নত নয়। প্রাচীন সভ্যতার কিছু নিদর্শন দেশটিতে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। রয়েছে প্রাচীন অসংখ্য ধর্মীয় নিদর্শন।
এগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে গুরুত্বসহকারে। তার ওপর দেশটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ। তাই পর্যটন শিল্প গড়ে না উঠলেও পর্যটন থেকে আয় কম নয়। বছরে গড়ে সাত লাখেরও বেশি পর্যটক ভ্রমণ করে দেশটিতে। কলা, স্থাপত্য, কাব্য ও সঙ্গীত শিল্পে ঐতিহ্যগতভাবে সমৃদ্ধ মেসিডোনিয়া। সঙ্গীত, কাব্য, সিনেমাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর অসংখ্য উৎসব হয় এখানে। পেইন্টিং ও কারুশিল্পও উন্নত মানের।
দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ অর্থডক্স চার্চের অনুসারী। মুসলিম ৩৩ শতাংশের বেশি। দেশটিতে ১২ শত চার্চ এবং চার শ’ মসজিদ রয়েছে। মাধ্যমিক স্কুলে প্রধান দু’টি ধর্ম পড়ানো হয়। রাজধানীতে অর্থডক্সদের একটি কলেজও রয়েছে। মেসিডোনিয়া ইউরোপে অন্যতম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। সংখ্যা এবং অনুপাতে এর চেয়ে বেশি মুসলিম অধ্যুষিত ইউরোপীয় দেশ হচ্ছে তুরস্ক, কসোভো, আলবেনিয়া, বোসনিয়া হার্জেগোভিনা। কসোভোয়, আলবেনিয়ায়, হার্জেগোভিনার মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে ৯০, ৭০ এবং ৪৮ শতাংশ মুসলিম। ২০০২ সালের শুমারি অনযায়ী মেসিডোনিয়ায় মসলিমদের সংখ্যা ৬ লাখ।দেশটিতে ইহুদির সংখ্যা সাত হাজারের কিছু বেশি।
মেসিডোনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা চারটি ধাপে বিভক্ত। প্রি-স্কুল, প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল এবং এর পরই রয়েছে উচ্চশিক্ষা। দেশটিতে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। রয়েছে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৮৬টি। ৭ থেকে ১৫ বছরের শিশুরা এখানে শিক্ষা নেয়। প্রায় দশ বছর আগের এক হিসাবে দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ শিশু প্রাইমারিতে শিক্ষা নেয়। সরকারি ব্যয়ের ২০ শতাংশ খরচ হয় শিক্ষা খাতে।