বছর ঘুরে আবারো এল ঈদুল আজহা। মুসলিম জীবনে ঈদুল ফিতরের মতো আরেকটি আনন্দ উৎসব এই ঈদুল আজহা।
এদিন ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা সকলেই ঈদগাহে সমবেত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করবে।
আর সামর্থ্যবান মুমিন বান্দারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় তাদের কোরবানির পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করবে।
এরপর আল্লাহর মেহমানদারী গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করবে।
তাৎপর্যগত দিক থেকে ইসলামী ঈদ আর অন্যান্য ধর্মের পর্ব উৎসবের মাঝে এই পার্থক্য রয়েছে যে, অন্যান্য ধর্মে যেখানে শত বছরের পুরনো কোনো ঘটনা কিংবা বিশেষ কোনো ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে বছর বছর উৎসব উদযাপিত হয়; সেখানে ইসলাম মুমিনের ইবাদতের পুরষ্কার হিসেবে আনন্দের কথা বলে।
তাই এক মাস সিয়াম সাধনার সৌভাগ্যের আনন্দ উৎসব হল ঈদুল ফিতর। আর হজ, কোরবানি ও আল্লাহর মেহমানদারী লাভের আনন্দোৎসব হচ্ছে ঈদুল আজহা।
কবে থেকে প্রচলিত কোরবানির আমল?
কোরবানির মূল সূত্র যদিও মিল্লাতে ইবরাহীমিতে বিদ্যমান ছিল কিন্তু মিল্লাতে ইবরাহীমির ‘সেই’ ঘটনাই আমাদের আনন্দের মৌলিক উৎস নয়; বরং আমাদের আনন্দের অন্তর্নিহিত কারণ তাই যা ইতোপূর্বে বলা হয়েছে।
কারণ কোরবানি ইসলামেরই একটি স্বতন্ত্র বিধান এবং শরীয়তে মুহাম্মাদীর ‘শিআর’ বা আনন্দপ্রতীক। যুগে যুগে কোরবানি বা প্রিয় পশু আল্লাহর দরবারে উৎসর্গ করার ইতিহাস সুদীর্ঘ।
হযরত আদম (আ.) এর দুই সন্তানের কোরবানির কথা বিবৃত হয়েছে সূরা মায়েদায়। এবং সেই কোরবানির প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর একটি বর্ণনায়।
বর্ণনাটি এরকম- হযরত আদমের (আ.) দুজন ছেলে ছিল। হাবিল আর কাবিল। হযরত হাওয়া (আ.) প্রত্যেকবার এক জোড়া সন্তান প্রসব করতেন। একটি ছেলে অপরটি মেয়ে। এই জমজ ভাইবোনদের বিয়ে ছিল হারাম।
তাই তখন এক গর্ভে জন্মলাভ করা ছেলের সঙ্গে ভিন্ন গর্ভে জন্মলাভ করা মেয়ের বিয়ের নিয়মই প্রচলিত ছিল। কাবিলের জমজ বোনটি ছিল সুশ্রী। জমজ হওয়ার কারণে তাকে কাবিল বিয়ে করার নিয়ম না থাকলেও তার জেদ ও হঠকারিতা ছিল যে, সে তাকে বিয়ে করবেই।
অন্যদিকে হকদার হওয়ার দাবি ছিল হাবিলের। এই দ্বন্দের ফয়সালা হল এভাবে-প্রত্যেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে কিছু কোরবানি করবে। যার কোরবানি কবুল হবে তার দাবিই গ্রহণযোগ্য হবে।
হাবিল একটি দুম্বা ও কাবিল কিছু ফলফলাদির কোরবানি পেশ করল। তখনকার দিনে কোরবানি কবুল হওয়ার নিদর্শন ছিল, আকাশ থেকে আগুন নেমে কবুলকৃত কোরবানি খেয়ে ফেলত।
যথারীতি আগুন এসে হাবিলের দুম্বাটি খেল, কাবিলের কোরবানি রয়ে গেল মাটিতেই। কিন্তু তা মেনে নিতে পারেনি কাবিল। প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে সে হত্যা করে ফেলল তার ভাইকে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৪৮)
সূরা মায়েদার ২৭ থেকে ৩১ আয়াত পর্যন্ত এই ঘটনাটি আরো সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত হয়েছে।
হযরত আদমের (আ.) পর প্রত্যেক উম্মত বা জাতির মধ্যেই এই বরকতময় আমল বিদ্যমান ছিল।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, আর প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কোরবানি নির্ধারণ করেছি। যেন তারা আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ পশুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের ইলাহ তো এক আল্লাহ। অতএব তোমরা তারই অনুগত থাক এবং (হে নবী) আপনি সুসংবাদ দিন বিনীতদের। (সূরা হজ : ৩৪)
উল্লেখ্য যে, বিধান থাকলেও সকল উম্মতের কোরবানির নিয়ম এক ছিল না। ইসলামী শরীয়তে যে পদ্ধতিতে কোরবানি করা হয় তাও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে নির্দেশিত এবং তা মিল্লাতে ইবরাহীমির অংশ।
কোরবানি কেন করব,কার জন্য করব?
মিল্লাতে ইবরাহীমের সে মহান কোরবানির সূত্র ধরেই আমাদের জন্য আল্লাহ ও রাসূল প্রবর্তন করেছেন এই মহান ইবাদতের। ত্যাগ ও বিসর্জনের এই নিঃশর্ত আনুগত্যের।
কোরবানির মূল প্রাণ বা প্রাণ কথা হল- তাকওয়া-খোদাভীতি, আল্লাহর প্রতি নিখুঁত মুহাব্বত ও ইখলাস।
তাকওয়া, মুহাব্বত ও ইখলাস প্রত্যেকটি হৃদয়ের সাথে সম্পৃক্ত। কারণ আল্লাহর গোশতের প্রয়োজন নেই, রক্তের প্রয়োজন নেই। তিনি তো শুধু মুমিনের তাকওয়ার পরীক্ষা নিতে চান।
লোক দেখানো, মানুষের বাহবা কুড়ানো, পার্থিব বড়ত্বের প্রতিযোগিতা, বড় লোকের কাতারে শামিল হওয়া এবং ‘আমার ছেলেরা কার দুয়ারে গোশতের জন্য ধর্ণা দেবে’-এ ধরনের পার্থিব মানসিকতার কোরবানি হয়তো সেই সব সামান্য উদ্দেশ্যকে পূরণ করতে পারে, কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গিত ‘নজরানা’ হতে পারে না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ নিজেই বলেছেন- নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মুত্তাকীদের কোরবানিই কবুল করেন। (সূরা মায়িদা : ২৭ )
এই কারণেই পূর্ণ ইখলাস ও মুহাব্বতের সাথে শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কেউ কোরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে মকবুল হয়। এমনকি পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হওয়ার কথা হাদীসে এসেছে। (জামে তিরমিযী, হাদিস : ১৪৯৩)
কোরবানির গোশত কী করব?
কোরবানির গোশতের এক ভাগ গরীব-মিসকীনদের আরেক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের এবং বাকি এক অংশ কুরবানীদাতাদের খেতে বলা হয়। এটি মুস্তাহাব।
হাদিসের পাতায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল এমনই পাওয়া যায়।
কোরআনেও আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- এসব পশুর গোশত থেকে তোমরা খাও এবং বিপন্ন অভাবগ্রস্তদের খাওয়াও। (সূরা হজ: ২৮)
আরো বলেছেন- তা হতে তোমরা খাও এবং ধৈর্য্যশীল ও যাচনাকারী উভয় ধরনের অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও। (সূরা হজ: ৩৬)
ইসলামের প্রথম যুগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বছর কুরবানীর গোশত তিন দিনের চেয়ে বেশি খেতে নিষেধ করেছিলেন।
এ সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, নবীজীর যুগে কুরবানীর সময় কিছু গ্রাম্য দরিদ্র মানুষ নবীজীর দরবারে এসেছিলেন। তাদের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য লক্ষ্য করে তিনি এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। আর বাকি গোশতগুলো অভাবীদের দান করতে বলেছিলেন।
পরের বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নিষেধ তুলে নেন এবং অনুমতি দিলেন, (যতদিন ইচ্ছা) খাও, সদকা কর এবং জমা রাখ। (সহীহ বুখারী: ৫৪২৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৯২৭)
উপরোক্ত হাদীসে ক্ষুধার্ত লোকদের অবস্থার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার একটি শিক্ষা নিহিত রয়েছে।